জালাল উদ্দিন আহমেদ
শিশু বিকাশের একাল সেকাল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫১ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪
সে ষাটের দশকের কথা। ক্লাস টু থ্রিতে পড়ি বোধ হয়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ভূমন্ডলে তখন একটা সার্বিক ক্রাইসিসের হিড়িক পড়েছিল। সর্বক্ষেত্রেই তখন দৌড়াদৌড়ি, টানা হেঁচড়া, অভাব অনটনের একটা মৃদু আওয়াজ। বয়স তখন বেশী না হলেও সামাজিক ঘটনা চক্রের দু'একটি ছবি এখনো মানসপটে ভেসে উঠে। তবে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ভারত স্বাধীন হওয়া এবং দুটি ধর্মর্ভেদের ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর যে শরনার্থীয় আদান প্রদানের শোরগোল উঠেছিল সেসব দৃশ্যপট আমার চোখে পড়েনি। এটা নিয়ে সামাজিক কোন অস্বস্তি বা অশান্তির কোন ঘটনাই আমার মনে আসে না। একটা কারন হয়তোবা হতে পারে। দুই বাংলার সীমান্ত সংশ্লিষ্ঠতায় আমার অবস্থান ছিল না বলেই একটা শান্ত আবহের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে আমার বেড়ে উঠার সময়কাল পেয়েছিলাম। তবে সাম্প্রদায়িক না হলেও সামাজিক অভাব অনটন ও তার ফলে সৃষ্ট অসন্তোষের ব্যাপারগুলো চোখে পড়তো। সে সময়ের সরকারী অনুদান ও রেশনিং ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দু'একটি শোরগোলের চিত্রের রিল মাঝে মধ্যেই আবছা ভাবে আমার এই সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে টোকা মারে। কতই বা বয়স হবে তখন। খুব জোর দশ এগার। তারপরেও শিশু বয়সের সেসব অভিজ্ঞতার টুকরো ছটাগুলো মাঝেমধ্যেই মানসপটে ভেসে উঠে।
আমরা তখন নিতান্তই ছোট। প্রাইমারী স্তরে লেখাপড়া করি। মনে পড়ে মাঝে মধ্যেই জেলা প্রশাসন থেকে স্কুলের বাচ্চাদের জন্য বড় বড় খাস্তা বিস্কুট আর দুধ দেয়া হোত। তবে এখনকার মত সুন্দর প্যাকেটজাত কায়দায় নয়। খোলা গুড়া দুধ আর টিন থেকে বের করা গোটা চারেক বড় বড় খাস্তা বিস্কুট। সপ্তাহে দুই বা তিনদিন ক্লাস ছুটির পর তা বিতরন করা হোত। বাসা থেকে পাত্র বা বাটি আনতে বলা হোত। ছুটির পর লাইন ধরে আমাদেরকে তা নিতে হোত। লক্ষ্য করতাম হলুদ বর্নের চকমকে বস্তায় ভরা সেই গুড়া দুধ নির্দিষ্ট মাপের চামচ থেকে প্রত্যেককে যেটুকু দেয়া হোত তা থেকে এক সের দুধ বানানো যেত। তবে এটাও মনে পড়ে, বাসায় নেয়ার পথে অর্ধেক গুড়া দুধ আমরা এমনিই খেয়ে ফেলতাম। শিশু বয়সের চাঞ্চল্য যাকে বলে। এটা নিয়ে অবশ্য বাড়িতে কোন গোল হতে দেখি নি। কারন ঘরে তো দুধের গাই বাঁধা। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা যারা স্বচ্ছ্বল পরিবারের ছিলাম তাদের ক্ষেত্রেই এই হাত চেটে গুড়া দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা ঘটতো বেশী করে। অবশ্য খাস্তা বিস্কুটটা নিয়ে ঘরের সদস্যদের একটু হলেও আগ্রহ ছিল। কারন ওধরনের বিলাতী বিস্কুটের ব্যাপারে সবার মনেই তার স্বাদ নেয়ার প্রবনতা লক্ষ্য করতাম। কারন ওধরনের বিস্কুট বাজারে পয়সা দিয়েও পাওয়া যায় না। ওই সময়ে খুব জোর ব্রিটানিয়ার খাস্তা বিস্কুট আর দাঁতভাঙ্গা লেড়ুয়া(টোস্ট) বিস্কুটই পাওয়া যেত। তবে সপ্তাহে তিনদিন কিন্তু দুধ দেয়া হোত না। একদিন দুধ, দ্বিতীয় দিন ভুট্টার সঙ্গে চিনি মেশানো হলুদ রঙের শিশু খাদ্য এবং পরের দিন সুজি জাতীয় চিনি মেশানো সিরিয়াল। মনে পড়ে অনভ্যাসের খেসারতে ভুট্টা মিশ্রিত শিশু খাদ্যটি প্রায়শঃ ক্ষেত্রে বাড়ির হাঁস বা ছাগলের পেটে যেত।
আমার যতদূর মনে পড়ে এই দুধ ও বিস্কুট বিতরনের বিষয়টি ছিল দ্বিতীয় মহাসমরের বিজয়ী শক্তি আমেরিকা ইংল্যান্ডের তরফ থেকে মানবিক অনুদান। সদ্য মুক্ত হওয়া কলোনীভুক্ত দেশের শিশুদের অপুষ্টি নিরসনের উদ্দেশ্যে এই শিশুখাদ্য তারা পাঠাতো। তবে ওইসব দুধ ও শিশুখাদ্য নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে মাঝেমধ্যে অসন্তুষ্ট হতে দেখেছি। অনেক সময় সেসব খাদ্য মানসম্পন্ন নয় বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অনুযোগ বা সমালোচনা করতেন যা তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেহেতু বৃটিশদের পন্য ছিল বিধায় অনেক সময় আমাদের বাড়ি থেকেও নেগেটিভ এপ্রোচ লক্ষ্য করতাম। তবে আমরা আধা দরিদ্র ও আধুনিক সুবিধা বঞ্চিত মফস্বল জনপদের ছেলে পুলেরা ঐসব বিলেতী খাওয়া পেয়ে স্বর্গ পাওয়ার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতাম। পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দশকের কথা এসব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দু'শ বছরের কলোনী ভারত পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মকে সুস্থ্যভাবে গড়ে তোলার এ এক ধনবাদী বেনিয়া উন্নাসিকতা। উন্নাসিকতা বলছি এই কারনে যে, যেসব শিশুখাদ্য ঐসময় খয়রাতি বা রিলিফ হিসাবে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগকে দেয়া হোত তার গুনগত মান ও তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করার পর্যায়ে তখন সদ্য মুক্ত ভারত বা পাকিস্তান প্রশাসনের ছিল না। মিত্রশক্তির গুদামজাত হয়ে পড়ে থাকা ওইসব খাদ্য সমূহের গুন মান্যতা নিয়েও আমাদের কথা বলার স্পর্ধা ছিল কিনা সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। যুদ্ধ পরবর্তী আগোছালো রাষ্ট্র সমূহ নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার বাস্তবতায় প্রানান্ত করছে তখন। আর অন্যদিকে যুদ্ধবাজ মোড়ল আমেরিকা ও ইউরোপীয় রাষ্ট্র সমূহ নিজেদের কক্ষচ্যুত কলোনীগুলোতে মানবতার প্রলেপ দেয়ার দৃশ্যমানতায় ওইসব শিশুখাদ্য ও অন্যান্য খয়রাতি চমক নিয়ে নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচারের কৌশল অবলম্বন করেছে। এর কারন অবশ্য ছিল। তখনও লীগ অব নেশন্সের রাষ্ট্র সংঘ আদলে UNICEP, WFP, WHO, FAO বা UNDPর আত্মপ্রকাশ ঘটেনি। ফলে দ্বিপক্ষীয় জানাশোনা এবং মিল-মহব্বতের তাগিদেই এসব সাহায্য সহযোগিতার কাজগুলি হোত।
এই বিষয়টি আমাদের একাত্তর পরবর্তী যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশেও দেখেছি। ইউনিসেফ, সেভ দি চিল্ড্রেন বা বিভিন্ন নামকরা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশু সুরক্ষার কর্মসূচী হিসাবে শিশুস্বাস্থ্য, শিশুখাদ্য, টিকা, বইখাতা স্বাস্থ্য সচেতনেতার কাজগুলি হতে দেখেছি। প্রায়োগিক চিত্রটা হয়তো ভিন্ন আঙ্গিকে হয়েছে। সময় বদলেছে। সুতরাং পরিসেবার ধরনও আধুনিক আঙ্গিকে হবে-সেটাই তো স্বাভাবিক। বিশ্বময়তার যুগে জাতিসংঘ ক্লাব সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীটা এখন একটা Global Village এর রূপ নিয়েছে। সৃষ্টির আশরাফুল মোখলুকাত বা সেরা জীব হিসাবে মানুষ এখন মানব জাতির কল্যানে সমন্বিত আয়োজনেই সব কিছু করে থাকে। খরা পীড়িত দারিদ্র্য সংকুল আফ্রিকার প্রত্যন্ত কোন গরীব দেশে ক্ষুধাপীড়িত ছোট শিশুরা যখন অপুষ্টি অনাহারে ধুকতে থাকে তখন বিত্ত বৈভবে লালিত অঞ্চলের আহ্লাদি শিশুটিও তার টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তাদের বেঁচে থাকার নায্যতা নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের টনক নড়িয়ে দেয়। পৃথিবী জুড়ে মানবতার ঝান্ডা হাতে তাইতো আজকের দিনে জাতি সংঘের ইউনিসেফ তার নিরলস কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। আমার সেই ছোট্টবেলার স্মৃতির ছটা আজকে মহাবিশ্বের শিশু কল্যানের সোপান হয়ে আজও মনকে নাড়া দেয়। সেদিনের সেই আগোছালো শিশু কল্যানের বিচ্ছিন্ন ঘটনা যুগ পরম্পরায় আজ বিশ্ব সম্প্রদায়ের উঠানে ইউনিসেফ ও অন্যান্য শিশুতোষ কর্যক্রমের চাদরে স্বস্তির সুবাতাস ছড়াচ্ছে। মানব সভ্যাতার সিঁড়িপথে এভাবেই জাতিসংঘ সৃষ্টির বিশ্বময়তায় আজ দুনিয়াজোড়া মানুষ তার চাহিদার সর্বক্ষেত্রে সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল উপভোগ করছে।