avertisements 2

একাকিত্বে বিলীন জীবন প্রদীপ

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ ফেব্রুয়ারী,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:২৯ এএম, ৭ মে,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

ছেলে নিশান এবং স্ত্রী বিউটি হতে চেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। সে লক্ষ্যে তাদের জন্য সেখানে বাড়িও কিনে দিয়েছেন আবু মহসিন খান (৫৮)। সেখানেই থাকেন স্ত্রী-সন্তান।

অন্যদিকে নিজের অসুস্থতা এবং ইমিগ্রেশন-ভিসা জটিলতায় গত ৪ বছর ধরে দেশেই অবস্থান করছিলেন তিনি। এ সময়ে একবারও দেশে আসেননি স্ত্রী ও ছেলে।

আর মহসিনের মেয়ে মডেল মুশফিকা খানম তিনার বাসায় থাকার আহ্বান জানানো হলেও থাকতে রাজি হননি-এমন দাবি মেয়ের স্বামী চিত্রনায়ক রিয়াজের।

আর এসব কারণে করোনা পরিস্থিতিতেও রাজধানীর ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে সম্পূর্ণ একা থাকতে হয়েছে মহসিনকে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যবসার লোকসান ও নিকট লোকদের কাছ থেকে আর্থিক লেনদেনে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা।

সব মিলিয়ে একা থাকার কারণে কষ্ট ভাগাভাগি করার মতো কাছের মানুষও খুঁজে পাননি। প্রাথমিকভাবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এসব কারণে মহসিন হয়তো আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন।

তবে এটি নিছক আত্মহত্যা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে- তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে শ্বশুরের আত্মহত্যার ঘটনায় চিত্রনায়ক রিয়াজ বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার ধানমন্ডি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন।

আর যাদের হাতে প্রতারিত হয়ে কোটি কোটি টাকা খুইয়েছেন তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করে গেছেন মহসিন নিজেই। ওই তালিকাটি এখন পুলিশের হাতে।

তালিকা অনুযায়ী প্রতারকদের খুঁজছে পুলিশ। পুলিশ, মহসিনের স্বজন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনায় থানা পুলিশ ছাড়াও ছায়া তদন্ত শুরু করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এবং র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।

ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ বিভিন্ন আলামত। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আলামতগুলো পরীক্ষার জন্য সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

মহসিন ফেসবুক লাইভে যে দুজনের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন বলে নাম উল্লেখ করেছেন, এখনো আমরা তাদের হদিস পাইনি। মহসিনের বাসা থেকে যে নামের তালিকা পেয়েছি সেগুলো যাচাই করে দেখছি।

এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। আমরা সব কিছু বিশ্লেষণ করছি। বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া নোটবুক, মোবাইল ফোন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিআইডি ল্যাবে পাঠিয়েছি। অস্ত্র ও গুলির খোসা ব্যালেস্টিক পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। এসব পরীক্ষার রিপোর্ট এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাবে।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, ঘটনার পরপরই আমাদের ক্রাইমসিন ইউনিট ঘটনাস্থলে যান। আলামত সরবরাহ করেন। এসব আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আমরা ছায়া তদন্ত চালাচ্ছি। তবে এখনো বলার মতো কিছু অগ্রগতি হয়নি।

ধানমন্ডি থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া যুগান্তরকে বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা তদন্ত চলছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে। ঘটনার আগে তার বাসায় কেউ প্রবেশ করেছিল বলে এখনো আমরা জানতে পারিনি।

ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডের ২৫ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন মহসিন। বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুক লাইভে এসে পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি চালিয়ে নিজ ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করেন তিনি।

প্রস্তুতি নিয়েই আত্মহত্যা করেন তিনি। ফেসবুক লাইভে বিস্তারিত বলেছেন। চিরকুটে সবকিছু লিখে গেছেন। লাইভে বলেছেন, ‘আমার এক বন্ধু ছিল, নাম কামরুজ্জামান বাবলু। যাকে আমি না খেয়ে তাকে খাইয়েছি। সে আমার ২৩ থেকে ২৫ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে। এভাবে বিভিন্ন মানুষের কাছে পাঁচ কোটি ২০ লাখ টাকা পাই। শেষ যেই মানুষটাকে বিশ্বাস করেছি, তার নাম হলো নোবেল সাহেব। মিনারেল ওয়াটার ফ্যাক্টরি করার জন্য তাকে মেশিন আনার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তাকে সাত লাখ ১০ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করেছিলাম, কিন্তু আড়াই বছর হয়ে গেছে। ঝগড়াঝাটি করার পর দুদফায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা ফেরত দেয়। এখন পর্যন্ত বাকি টাকা ফেরত দিচ্ছে না।’

মামলার এজাহারে রিয়াজ বলেন, আমার শ্বশুরের গার্মেন্টস ব্যবসা ছিল। করোনা মহামারির কারণে তার ব্যবসা মন্দা যাচ্ছিল। তার ব্যবসাকেন্দ্রিক অনেক টাকা-পয়সা লেনদেন আছে।

তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তিনি একাই ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে থাকতেন। আমি স্ত্রীকে নিয়ে বনানীতে থাকি। আমার শাশুড়ি এবং শ্যালক অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন।

আমার শাশুড়ি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর থেকে আমি এবং আমার স্ত্রী মাঝেমধ্যেই তার (শ্বশুরের) খোঁজখবর নিতাম। তাকে আমাদের বাসায় থাকতে বলি।

কিন্তু তিনি রাজি না থাকায় সেখানে নিতে পারিনি। রিয়াজ বলেন, আমার শ্বশুর ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার একটি কিডনিও ফেলে দেওয়া হয়েছে। কলাবাগান থানা এলাকায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল।

তিনি তার ব্যবসায় লোকসানের কথা আমাদের জানাতেন। অনেকের কাছে টাকা-পয়সা পাবেন বলেও জানিয়েছেন। পাওনা টাকা আদায় করতে না পারা এবং করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় তিনি হতাশাগ্রস্ত ছিলেন।

গত ১০-১২ দিন ধরে তার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তার এ অবস্থা দেখে আমি ও আমার স্ত্রী তাকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরামর্শ দিই। কিন্তু তিনি সেখানে যেতেও রাজি হচ্ছিলেন না।

বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মহসিনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

লিপু বলেন, মহসিন দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকেছেন। টানা তিন বছর থাকার পর ১০-১২ দিনের জন্য দেশে আসতেন। কিন্তু গত ৪ বছর ধরে তিনি দেশেই একা অবস্থান করছিলেন।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তার যে ক্যানসারের সিম্পটম পাওয়া গেছে, সেটা যদি আবার রিটার্ন করে তাহলে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে সব খরচ বহন করতে হবে। তাই অস্ট্রেলিয়া সরকার এ রিস্ক নেবে না।

এ কারণে তিনি অস্ট্রেলিয়া যেতে পারছিলেন না। তিনি আরও বলেন, মহসিন স্বাধীনচেতা মানুষ। তাই তার বাসাতেই থাকতেন। বলা হয়েছিল অন্য কারও সঙ্গে থাকতে। আমরা দূর থেকে যতটুকু সম্ভব সাপোর্ট দিয়েছি।

খাবার-দাবার রান্না করে দিয়ে যাওয়া, এতটুকু আমরা করতে পেরেছি। এ ফ্ল্যাটটা তার নিজের। এটা ছাড়া তিনি অন্য কোথাও থাকতেই চাইতেন না। তার মোহাম্মদপুরেও ফ্ল্যাট আছে, কলাবাগানেও আছে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2