জালাল উদ্দিন আহমেদ
ক্ষমতার দাম্ভিকতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর, বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০৮:৪৪ পিএম, ৬ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
কি আজব বসবাস আমাদের। আমরা যাব কোথায়? একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দেশে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে বসে থেকে যখন গণতন্ত্রকে কটাক্ষ করে এই বয়ান আসে তখনও আমরা বোবা কালা হয়ে বসে থেকে জয় বাংলা বা জিন্দাবাদের লড়ে লক্কায় গলদঘর্ম হই। এরা কি জনগনের জন্য রাজনীতি করে! না দেশের জন্য? ক্ষমতার চেয়ারটিই কি তাদের রাজনীতির সবকিছু! 'সব বন্ধ করে দেব। আগে যেমন ছিল সে অবস্থায় এনে চুপ করে বসে থাকবো। ইলেকশনের পর ক্ষমতায় এলে আবার বাড়িয়ে দেখিয়ে দেব'। কি সব আজগুবি, অমানবিক ও অযৌক্তিক কথাবার্তা। তাও আবার ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখর থেকে! তিনিই তো আমাদের জননেত্রী দেশরত্ন আরও কত কি! তবে বাংলার হেঁসেলে এসব শব্দ চয়ন ও তার প্রায়োগিক হিসাব নিকেশ যুগে যুগে ছিটে ফোঁটা ভাবে হয়নি তা বলা যাবে না। গত শতাব্দীর সত্তর দশকে ‘'লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দিব’’ কিংবা বন্দি রাজনৈতিক নেতাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার পর সংসদে দাঁড়িয়ে দম্ভ ভরে “কোথায় আজ সিরাজ শিকদার” শুনে আমরা হতচকিত হয়েছিলাম কিন্তু ঘাবড়ে যাই নি। আজকের একবিংশের বটতলায় আমাদের আঁধার ঘরে মোমের বাতি মাননীয়ার মুখ থেকে 'সব বন্ধ করে দিব'' উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে সেকেন্ড ইন বা থার্ড ইন কমান্ডদেরও যে মুখে খৈ ফুঠছে তা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। পারমানবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাঁচামাল ইউরেনিয়াম সবেমাত্র দেশে ঢুকেছে। সেকেন্ড ইন কমান্ড মশাই উচ্চারন করলেন, 'সবার মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে নিশ্চিহ্ন করে দেব'। কি ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা! আরেকজন তো নারী দিবসের আলোচনার বলেই ফেললেন, 'নারী নেত্রীদের সাজিয়ে গুজিয়ে বিদেশীদের কাছে পাঠানো হয়'। ছিঃ! এসব কুরুচিপুর্ণ ও অশ্রাব্য ভাষা এখন রাজনীতির উঠানে উচ্চারিত হয় অহরহ। আর আমাদের মধ্য থেকে বাছাই করা গোলাম হোসেনরা এসব নিয়ে হাততালি দেয়, নাচানাচি করে।
রাজনীতির এই অরুচিকর কথাবার্তা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পর চালু হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। তবে ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু, তারা আমাদের অহংকারের সুতি হোক কিংবা গর্বের জায়া হোক না কেন, তাদের মুখ থেকে এসব অশ্রাব্য কথাগুলি জনসম্মুখে যখন উচ্চারিত হয় তখন হাড় হাভাতে বাঙালীর চুপসে যাওয়া ছাড়া আর গতি কি? বাচিক বা বিতার্কিকরা হয়তো চিল্লাইয়া বলে উঠবেন, কেন আন্দোলন প্রতিবাদ এগুলো কি উবে গেছে! হয়তোবা তাই। নইলে এত এত অর্থ কেলেঙ্কারী তছরূপ ও পাচারের ঘটনাগুলো থলে থেকে বের হচ্ছে তারপরেও কি বাঙালীর কানে তা ঢুকছে না! বাঙালী বীরের জাতি, বাঙালী প্রতিবাদ করতে জানে, বাঙালী তার অধিকার আদায়ে সর্বদা সচেতন, বাঙালীর সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। সুতরাং সেই বাঙালী কেন চুপ করে থাকবে! একজন পুলিশের উর্দিপিরা সিপাহী যখন ক্ষমতার পেয়াদা হয়ে লক্ষ কোটি ডলারের মাল্টি মিলিয়নীয়ার বনে যান তখন মন্ত্রী এমপি সচিব চাপড়াসিরাও বা বাদ থাকবে কেন! কথা বলা যাবে না, গান করা যাবে না, কবিতা লিখতে হাজারো বেড়া, রাজনীতির মিটিং মিছিল করতে হলে উর্দিপরা সিপাহীর অনুমোদনের জন্য তার দরজায় দরখাস্ত নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে - এ কোন্ গনতন্ত্র? বীর বাঙালী বঙ্গবন্ধুর গগন বিদারী জয় বাংলা শ্লোগানে আমরা বর্বর পাকিস্তানীদের বাংলা ছাড়া করেছি। সেই বাঙালী আজ এত হতচ্ছাড়া হলো কিভাবে! কেন বাঙালী আজ তার মৌলিক গনতন্ত্রের সামান্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা হীনতায় খাবি খাচ্ছে?
আমরা ভারতীয় থেকে পাকিস্তানী বাঙালী হলাম। বাঙালী তার ধর্মীয় অস্তিত্ত্ব সৃষ্টির গ্যাঁড়াকলে ভারত পাকিস্তানে দ্বিখন্ডিত হোল। সেই ধর্ম যখন তার জাতীয়তাবাদী আদি অস্তিত্ত্বের মূলে কুঠারঘাত করলো তখন বাঙালী ধর্মভেদের বেড়া ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশী বাঙালী হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো। পথ পরিক্রমায় পৌনে এক'শ বছরের অর্ধশতাব্দী নিজেদের মুঠোয় নিলেও গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায় বিচার, নৈতিক মূল্যবোধ ও রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশ কি বাঙালীর হয়েছে? যে গণতন্ত্র, সামাজিক সমবিকাশ ও বন্টন ব্যবস্থার সুষ্ঠুতা আনয়নের আকাঙ্ক্ষায় বাঙালী ধর্ম নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আপন অস্তিত্ত্বের সার্বভৌমত্ত্বে থিতু হোল - সেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত্বে এবং রাজনীতির চলনে বলনে বাঙালী কি কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছে? রাজনীতির সুষ্টু বিকাশ এবং গণতন্ত্রের প্রায়োগিক স্বচ্ছ্বতায় কি আমরা উজ্জ্বলতা দেখাতে পেরেছি?
যে রাজনীতিতে লগি বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মেরে তার উপর নৃত্য করা হয়, যে রাজনীতিতে মানুষ ভর্তি চলন্ত বাসে গান পাউডার ছিটিয়ে নিরীহ বাসযাত্রীদের হত্যা করা হয়, যে রাজনীতিতে ক্ষমতার পালা বদল করতে হলে ১৮২৫ দিনের সরকার ব্যবস্থায় ১৭৩ দিন হরতাল ও অসংখ্য দিন অবরোধ মিছিল মিটিংএ দেশের শাসন ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দেয়া হয় কিংবা হরতাল সফল করার জন্য অফিসগামী সরকারী কর্মচারীকে দিগম্বর করে ভীতি ছড়ানো হয়, সেই রাজনীতির ধারকদের কাছে দেশের সুশাসন কি আশা করা যায়? ঐ যে লগি বৈঠার কথা বললাম, আসলে ওটাই বাঙালীর মারণাস্ত্র। নইলে একবিংশের এই ঝকমকে ডিজিট্যাল উঠানে এখনো সেই লগি বৈঠা! বাঙালী তার জাত চিনিয়েছে। এই লগি বৈঠার এতই জোশ যে তার উপর ভর করেই গত দেড় দশকে আমার এই কাদা মাটির বঙ্গভূমিতে এক লৌহ মানবীর জন্ম হয়, যিনি তার বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচিয়ে দুনিয়ার তাবড় শক্তিধর সুপার পাওয়ারদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরপাক খাওয়ান। পারলে নামাও। ক্ষমতার দাম্ভিকতায় তিনি আজ ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। ক্ষমতার স্পর্ধায় তিনি অবশেষে স্বৈরাচারীর খাতায় নাম লেখান। নইলে দাম্ভিকতার সীমারেখা যখন আমাদের জানাই থাকে তখন কোন সুতোর টানে তিনি তার পিতৃ উচ্চারনের মতই আমি আমি করে আস্ফালন করেন।
সুতরাং সেই ঐতিহাসিক বচন 'ভাতে মারব পানিতে মারব’ কথাটির প্রতিধ্বনি নয় কি এসব। মহান নেতার সেই রেসকোর্সের মহামুল্যবান 'ভাতে মারবো পানিতে মারবো' কথাটি মিলিয়ে তার রক্ত পরম্পরার 'সব বন্ধ করে দিব'র হুংকার কি আমাদের দিকে তাক করার সাযুজ্যে পড়ে না? আজ অর্ধ শতাব্দীর বাংলাদেশে তাঁরই উত্তর পুরুষ অপামর আমজনতাকে ধমক দিয়ে বলছেন 'সব বন্ধ করে দিব'। তাহলে থুতুটা কি উপরের দিকে মুখ করেই ছিটানো হয়েছিল?
এই লেখাটি যখন শুরু করেছিলাম তখন গণতন্ত্রে ফিরে আসার লড়াইয়ের একটা প্রচ্ছন্ন আয়োজনে দেশবাসী আশান্বিত হয়েছিল। মানুষ একদলীয় পরিবার তন্ত্রের তথাকথিত গণতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান কল্পে ক্ষণ গননা শুরুও করেছিল বলে মনে পড়ে। দেশের রাজনীতির সকল উঠান থেকে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মঞ্চও তৈরী হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে গণতন্ত্রের শত্রু বিবেচনায় শাসন ব্যবস্থায় জগদ্দল পাথরের মত জেঁকে বসেছে আওয়ামী লীগ নামের দলটি। যে দলের ইতিহাস ঐতিহ্যে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালীয়ানার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বের ঠিকুজি। সেই তারাই ক্ষমতার দন্ডে থেকে নিজেদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আয়োজনে রুদ্রমুর্তি ধারন ক’রে শাসক ও শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর হবেই বা না কেন? একদলীয় শাসনের প্রবর্তক পরম পরাক্রমশালী সেই মহান নেতার রক্ত পরম্পরাই তো বর্তমান সময়ের শ্বৈরশাসক আমাদের এই জগত্তারিনী মহামায়া রূপী প্রধানমন্ত্রী। বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে এক ব্যক্তি ও তার পরিবারকে মহিমান্বিত করে যেভাবে দেশ শাসনে তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়েছেন তাতে করে দুনিয়ার তাবড় স্বৈর শাসকেরাও এসব দেখে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে খাবি খাচ্ছে বলে মনে হয়। দেশের শাসন ব্যবস্থায় সবকিছুই হয়েছে ব্যক্তি মহত্ব ও সেই তথাকথিত মহামানবের কন্যার ক্ষমতার দন্ড হাতে স্বৈর শাসনের দুর্দমনীয় অতি মানবীয় শাসন ব্যবস্থায়।
কথায় বলে পচা শামুকে পা কাটে। এবং এই বচনের বাক্যটি বোধ হয় স্বাধীনতার তেপান্ন বছরে বার বার ঘুরে এসেছে আমাদের সবুজ শ্যামল দুখিনী বাংলার ক্ষমতার পিলো পাসিংয়ের এই জমিনে। কখনও নৃশংস উপায়ে কখনও বা কলঙ্ক লেপনের কালি মেখে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাধারন বাঙালীর অজস্র জীবনের রক্ত ঝরিয়েই এই শাসক বদলের কাজটি সম্পন্ন করতে হয়েছে। পঁচাত্তরে একনায়ক স্বৈরশাসকের রক্ষীবাহিনী বুচারীতে কমপক্ষে হাজার বিশেক ছাত্র জনতার জীবন বলিদানে দেশ থেকে স্বৈরশাসকের বিদায় হয়েছে। পরবর্তী সময়ের শাসন ব্যবস্থায় শৃংখলা বাহিনীর অন্তর্দন্দে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির জীবনাবসান হয়েছে। তৃতীয়জন সামরিক শাসক হলেও জনগনের অপচ্ছন্দে তাকে ক্ষমতার কুরসী ছাড়তে হয়েছে অসম্মানিত হয়ে। পরবর্তীতে পরম্পরার শাসন ব্যবস্থায় শাসককুল অসম্মানিত হয়েছেন ধারাবাহিকভাবে। এরই শিক্ষায় পুষ্ট হয়ে বংশ পরম্পরার অতি সম্প্রতির একনায়কোচিত স্বৈরাচারী শাসক অপ্রতিরোধ্য গতিতে তার স্বৈর শাসনের ভিত মজবুত করার লক্ষ্যে দেশের সাধারন মানূষ ও বিরুদ্ধ মতের রাজনীতির উপর হেন অপকর্ম নেই যা প্রয়োগ করেনি। জেল জুলুম খুন গুম ইত্যাদি দেশে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কোন রাজনীতিই কথিত বংশ পরম্পরার স্বৈর শাসককে তার অপকর্ম থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। কিন্তু ঐ যে বলেছি পচা শামুকে পা কাটার কথা। শেষমেশ সেটাই ঘটলো। সরকারী চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সামান্য কোটা সংরক্ষনের এক অখ্যাত এবং অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনে সরকারী এক নায়কতন্ত্রী বেপরোয়া আচরনে সরকারী দল ও তাদের অংগ সংগঠন এবং দীর্ঘ মেয়াদী শাসনের বশংবদ শৃংখলা বাহিনীর সশত্র আক্রমনে কয়েক'শ নিরীহ মেধাবী ছাত্রছাত্রী ঢাকার রাজপথে নিহত হোল। ফলে অরাজনৈতিক নিরীহ ছাত্রদের বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলন এক দফার আন্দোলন অর্থাৎ স্বৈরশাসক হাসিনা বিদায়ের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। আন্দোলনের প্রবলতা অবশেষে গণ অভ্যুত্থানের রূপ নিয়ে দেশ হতে শ্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করে।
তিরিশ লক্ষ বাঙালীর রক্ত ঝরিয়ে বিজাতীয় শাসকদের পরাভূত করে ১৯৭১এ নিজের মাটিকে বাঙালী মুক্ত করেছে। আজ ৫৩ বছর পর আবারো অকুতোভয় হাজারো ছাত্র জনতার রক্তস্নানে বাঙালী নিজেদের মাটির সন্তান খুনী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতার দ্বিতীয় স্বাদ এনে দিয়েছে। পাঁচ(৫)আগষ্ট,২০২৪ বাঙালী মুক্ত নিশ্বাসে স্বাধীনতার স্বাদে বুকভরে স্বাস নিয়েছে। আর ক্ষমতার দন্ডে আত্মহারা স্বৈরাছারী হাসিনা এখন দেশান্তরী হয়ে আশ্রয় প্রার্থনায় ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। মাফিয়া তন্ত্রের দাম্ভিকতা এভাবেই নির্মূল হয়। এটাই বিধির লিখন।
‘'সর্বে ভবন্তু সুখিন”