কে আমাকে বাবা বলে ডাকবে : ৩ মেয়েকে হারানো ফিলিস্তিনি বাবা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ১১:১০ এএম, ২ মে,শুক্রবার,২০২৫

গাজা শহরে এক বোমা হামলাতেই তিন মেয়েসহ ১০৩ জন স্বজনকে হারান আহমাদ আল ঘুফেরি। ভাগ্য গুণে বেঁচে যান তিনি। তখন তিনি বাড়ি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমতীরের জেরিকো শহরে অবস্থান করছিলেন। তিনি কন্যাশিশুকে হারিয়ে ফিলিস্তিনি এই বাবার প্রশ্ন, এখন কে আমাকে বাবা বলে ডাকবে।
মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এই ঘটনা বিবৃত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় আহমেদ আল-গুফেরির পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজা সিটিতে ছিল তার বাড়ি। সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল তার ১০৩ জন স্বজন। ইসরাইলের বোমা হামলায় তাদের সবাই নিহত হয়েছে। তিনি তখন ৮০ কিলোমিটার দূরে অধিকৃত পশ্চিমতীরের জেরিকো শহরে আটকা পড়েছিলেন। আর এতেই তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস যখন ইসরায়েল আক্রমণ করে, তখন আহমেদ তেল আবিবের একটি নির্মাণ সাইটে কাজ করছিলেন। পরে যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের সামরিক অবরোধের কারণে তিনি তার স্ত্রী এবং তিন কন্যার কাছে ফিরে যেতে পারেননি। তবে প্রতিদিন একই সময়ে তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে কথা বলতেন। মূলত যখন ফোন সংযোগ চালুর অনুমতি দেয়া হতো তখনই কথা বলতেন তিনি। আর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হামলার সময় তিনি তার স্ত্রী শিরিনের সাথে ফোনে কথা বলছিলেন।
আহমেদ আল-গুফেরি বলছেন, ‘সে (শিরিন) জানত যে সে মারা যাবে। সে আমাকে বলেছিল, সে যদি আমার সাথে খারাপ কিছু করে থাকে তাহলে তাকে যেন ক্ষমা করে দিই। আমি তাকে বলেছিলাম, এমন কথা বলার দরকার নেই। এটিই ছিল আমাদের ফোনে বলা শেষ কথা।’
ওই সন্ধ্যায় তার মামার বাড়িতে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় আহমেদ আল-গুফেরি স্ত্রী এবং তার তিন কন্যা - তালা, লানা এবং নাজলা নিহত হয়। একইসাথে আহমেদের মা, তার চার ভাই এবং তাদের পরিবার নিহত হয়। নিহত হয় তার কয়েক ডজন খালা, চাচা এবং চাচাত ভাই। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা শতাধিক। হামলার পর দুই মাস পার হয়ে গেলেও ধ্বংসস্তূপের নিচে তাদের কয়েকজনের লাশ এখনও আটকে আছে।
বিবিসি বলছে, গত সপ্তাহে ছিল আহমেদের ছোট মেয়ের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে নাজলার বয়স এ সময় দুই বছর হয়ে যেত। স্ত্রী-সন্তানদের চলে যাওয়ার পর দুই মাস পার হলেও আহমেদ এখনো বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি।
নিজের সন্তানদের লাশ হাতে ধরতে না পেরে বা তাদের সমাধিস্থ করতে না পেরে আহমেদ এখনো এমনভাবে কথা বলেন, যেন তারা বেঁচে আছেন। এ সময় অশ্রুতে যেন তার চোখ-মুখ স্থির হয়ে যায়।
আহমেদ আল-গুফেরি বলছেন, ‘আমার মেয়েরা আমার কাছে ছোট পাখির মতো। আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নের মধ্যে আছি। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, আমাদের কী হয়েছে।’
তিনি তার ফোন এবং ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মেয়েদের ছবি সরিয়ে দিয়েছেন, যাতে তাদের ছবি দেখে তিনি চমকে না ওঠেন। হামলায় বেঁচে থাকা কয়েকজন আত্মীয় এবং প্রতিবেশীর কাছ থেকে তিনি সেই দিনের ঘটনার বিবরণ পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
তারা তাকে বলেছে, একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রথমে তার পরিবারের বাড়ির প্রবেশপথে আঘাত করে। তিনি বলেন, ‘এরপর তারা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পাশেই আমার মামার বাড়িতে গেল। পনের মিনিট পরে, ওই বাড়িতে বিমান হামলা হয়।’
গাজা শহরের জেইতুন এলাকায় সাহাবা মেডিকেল সেন্টারের কোনে চার তলা ভবনটিতে হামলা চালিয়ে ওই পরিবারটিকে হত্যা করা হয়েছিল। হামলার পর এখন সেটি কেবলই কংক্রিটের একটি ঢিবি আর ধুলোময় পোশাকের টুকরো দেখা যায়।
আহমেদের জীবিত আত্মীয়দের একজন হামিদ আল-গুফেরি। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, হামলা শুরু হওয়ার পর যারা পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তারাই সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। আর যারা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা নিহত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘হামলায় চারদিকে আগুন লেগে গিয়েছিল। আমাদের পাশের চারটি বাড়িতে হামলা হয়েছে। প্রতি ১০ মিনিটে তারা একটি করে বাড়িতে হামলা করছিল সেদিন। আমাদের সন্তান এবং আত্মীয়সহ গুফেরি পরিবারের ১১০ জন লোক সেখানে ছিল। তাদের মধ্যে গুটিকয়েক ব্যতীত সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।’
জীবিতরা বলছেন, সেদিনের হামলায় সবচেয়ে বেশি বয়সী যিনি নিহত হয়েছিলেন তিনি ছিলেন ৯৮ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা; আর মাত্র নয় দিন আগে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে ছোট এক ছেলে শিশুও সেদিন প্রাণ হারায়।
আহমেদ আল-গুফেরির একজন চাচাতো ভাই - যাকে আহমেদ নামেও ডাকা হয় - বিমান হামলা থেকে হওয়া দুটি বড় বিস্ফোরণের বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘হামলার বিষয়ে কোনও আগাম সতর্কতা ছিল না। যদি (কিছু) লোক আগেই এই এলাকা ছেড়ে না যেত, আমি মনে করি শত শত মানুষ সেদিন নিহত হতো। এলাকাটি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন দেখাচ্ছে। সেখানে একটি গাড়ি পার্কিং, পানি রাখার জায়গা এবং তিনটি বাড়ি ও একটি বড় বাড়ি ছিল। তবে হামলার পর পুরো আবাসিক এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে।’
উম্মে আহমেদ আল-গুফেরি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা ঘরে বসে ছিলাম এবং মূহুর্তের মধ্যে আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপের নিচে দেখতে পেলাম। আমাকে একপাশ থেকে অন্য দিকে ছুড়ে ফেলা হলো। আমি জানি না কিভাবে তারা আমাকে বের করে এনেছে। আমরা আমাদের চোখের সামনে মৃত্যু দেখেছি।’
বিবিসি বলছে, বর্বর সেই হামলার আড়াই মাস পর উদ্ধারকারীরা এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা কিছু লাশের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। আর এই পরিবার একটি ছোট খননকারী যন্ত্র ভাড়া করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছে।’
আহমেদ বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা (আজ) চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি, যার মধ্যে আমার ভাইয়ের স্ত্রী এবং আমার ভাগ্নে মোহাম্মদ রয়েছে। তাদেরকে টুকরো টুকরো করে বের করা হয়েছে। তারা ৭৫ দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে ছিল।’
তাদের অস্থায়ী কবরগুলো কাছাকাছি খালি জমির একটি অংশে দেওয়া হয়েছে। এসব কবর লাঠি এবং প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। তবে পশ্চিম তীরের জেরিকোতে আটকে থাকা আহমেদ তাদের দেখতে পারেননি।
তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমি আমার মা, আমার স্ত্রী, আমার সন্তান এবং আমার ভাইদের দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমি কি করেছি? তারা সবাই বেসামরিক মানুষ ছিল।’
এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে এই পরিবারের অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সেনাবাহিনী বলেছে, তারা এই প্রশ্নবিদ্ধ হামলা সম্পর্কে জানে না এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) হামাসের সাথে যুদ্ধে ‘বেসামরিক ক্ষতি কমানোর জন্য সম্ভাব্য সকল সতর্কতা’ অবলম্বন করছে।
তবে জেরিকোতে অবস্থান করা আহমেদ এখনও মাঝে মাঝে গাজায় তার বেঁচে থাকা আত্মীয়দের ফোন করেন। কিন্তু নিজের প্রিয় বাড়ির বাইরে আটকে থাকার এবং ফিরে আসার জন্য মরিয়া থাকার পরও তিনি আর নিশ্চিত নন, আবারও তিনি তার বাড়িতে ফিরে যাবেন কিনা।
আহমেদ আল-গুফেরি বলেন, গাজায় আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। তার ভাষায়, ‘আমি কার জন্য ফিরে যাব? কে আমাকে বাবা বলে ডাকবে? কে আমাকে প্রিয়তম বলে ডাকবে? আমার স্ত্রী প্রায়ই আমাকে বলতেন, তার কাছে আমিই ছিলাম তার জীবন। এখন আমাকে কে এগুলো বলবে?’