জালাল উদ্দিন আহমেদ
গণ অভ্যুত্থান - একটি সার্জিক্যাল পোস্টমর্টেম
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৫:৫৪ পিএম, ৬ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তুলে মহাদেশ সাগর অতল। আমরা তো সেই সাগর সেঁচে মনিকাঞ্চন কুড়ানোর প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রগাঁথায় সাগরে নামি। ভাষা দিয়ে আমাদের চলার পথ তৈরী করে এগোতে চাই। এগিয়েও যাই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার সম্মিলিত আহ্বানে যুক্তফ্রন্ট করি। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান করে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিই। সত্তরে নির্বাচন করে সংহত গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল হই। কিন্তু বিধি বাম। দ্বিজাতীয় তত্ত্বের বেড়াজাল জিইয়ে রেখে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করতে গিয়ে ভেজালে পড়ি। বনিবনা না হওয়াতে আমরা ভিনু হয়ে যাই। কিন্তু এই ভিনু হওয়ার কাহিনী বড় নিষ্ঠুর মর্মন্তদ। তবুও পিছনে তাকানোর সময় আমাদের ছিল না। আপন জাতীয়তাবাদ ও স্বত্বাকে সমুজ্জ্বল করার অদম্য বাসনায় আমরা জীবন বাজি রেখে নিজেদের অস্তিত্বের শেকড় গেঁথেছি। লক্ষ প্রানের বিনিময়ে আমরা আমাদের বাঙালী অস্মিতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। ধর্ম নয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ে গঠন করেছি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে বাঙালী জাতীয়তাবাদের হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টানসহ পার্বত্য উপজাতীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সবাই মিলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্যই হয়তো ভূখন্ডের নাগরিক সামঞ্জস্যতায় আজ আমরা বাঙালী জাতীয়তাবাদকে একতরফা না করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবোধে উজ্জ্বল হয়েছি।
ছোট্ট করে একটু আয়নার সামনে দাঁড়ানো দরকার। আমরা কে, আমরা কি, আমাদের অস্তিত্ব,আস্মিতা নিয়ে - এই যে এত এত কথা বলে মুখে খৈ ফুটায় সেটা নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনার প্রয়োজন আছে বৈকি। কিন্তু মুস্কিল হয়েছে অন্যখানে। আমি তো কোন পন্ডিতস্মন্য ব্যক্তি বা মুরুব্বি নই, নই কোন অক্সফোর্ড হাভার্ড ব্রান্ডের স্কলারও। একজন সাধারন শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা নিয়ে নিজের অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে আমার পাগল হওয়া ছাড়া কোন উপায়ন্তর আছে বলে মনে হচ্ছেনা। আর্য অনার্যের আলোচনা করতে গিয়ে অন্য কোথাও হয়তো বলেছি যে মৌর্য বংশ বা সেন পাল ইত্যাদির আমলনামায় এসে আমরা বাঙালীত্বের স্বাদে নাম লিখিয়েছি। কিন্তু সেই পাল সেন বা পরবর্তী শাহ খাঁ এরা কি আদৌও এই মাটির ভূমিপুত্র ! উড়িয়া বিহারের মির্জা খানদানের যে সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে আমরা বাংলার শেষ নবাব বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি তা কতটুকু যথাযথ - সেটা ভাবার সময় কি এখনও আসেনি?
আজকাল যারাই ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দুতে এসে পড়েন, তারা তখন কেউ ইয়েমেনী, কেউবা বাগদাদী আবার অনেকেই এশীয় মাইনরের উচ্চ বংশীয় যোদ্ধা-শাসক বা পীর ফকিরের হাই প্রফাইল বংশ পরম্পরার সফেদ মানুষ বনে যান। কি মুস্কিল বলুন তো! পনের'শ বছর বয়সের ইসলাম ধর্ম তার গোড়াপত্তন হওয়ার পরবর্তী সময়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে মধ্যপ্রাচ্য, এশীয় মাইনর এবং পুর্ব ইউরোপে যেমন তারা তাদের শক্তিমত্তা ও শৌর্য বীর্যের ক্ষমতাবলে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন, পাশাপাশি প্রাচ্যে ও দক্ষিন পুর্ব এশিয়ায় তারা তাবলিগী দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাও তো সেটা খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে। সেক্ষেত্রে বার'শ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পর এতদাঞ্চলে ইসলাম প্রচারের গতি ত্বরান্বিত হয়। নিশ্চয় আমরা জেনেছি বাংলাদেশ বার আউলিয়ার দেশ। সেক্ষেত্রে অষ্টম শতাব্দীর পর হতে উপমহাদেশমুখী আরব দেশীয় মসলা, সুগন্ধি ও খেজুর আখরোট এর ব্যবসার অছিলায় আমাদের এই ভূখন্ডে ইসলামী পীর ফকির ও আলেমদের আগমন ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে তারা বন জঙ্গল কাদা মাটির বাংলাকে মনুষ্য বাসযোগ্য ভূমি হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মানুষের ভ্রাতৃত্ব বন্ধুত্ব ধৈর্যশীলতা সহনশীলতা এবং ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার ও তার প্রয়োগিক বাস্তবায়নে এতদাঞ্চলের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। বন বাদাড় সাফ করে সেখানে কিভাবে চাষাবাদ করে ফসল ফলাতে হয় তার শিক্ষা দেন। এমন একটা সময় ছিল যখন এ অঞ্চলের মানুষেরা শাক ও লতাপাতা সেদ্ধ করে খেত। এশীয় মাইনর ও মধ্য প্রাচ্যীয় মুসলমানেরা তাদেরকে মসলা দিয়ে রান্না করে খাওয়ার কৌশল শেখান। কঠামোগত বাড়ি বানানো, পাকা বাড়ি বানানো - এসব মুসলিম শিক্ষা। অর্থাৎ সভ্য জগতের খাওয়া দাওয়া চলাফেরা ইত্যাদির তালিম এই মুসলিম আলেম ও পীর ফকিরদের মাধ্যমে তারা অবগত হন। সভ্যতা সংস্কৃতি এবং সামাজিক আচার আচরনের শিক্ষা আমাদের ওখান থেকেই শুরু বলে মনে করা হয়। তাহলে হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্য কোনটি? রবি ঠাকুর বলেছেন,শক হুন দল মোঘল পাঠান একদেহে হোল লীন। সেক্ষেত্রে অরিজিন বলতে যা বুঝায় সেটার মজেজা কোথায়। মুসলিম শাসনের পুর্ববর্তী সময়ে যে সেন পাল মৌর্যদের কথা বলি তারা তো দাক্ষিণাত্য ও পশ্চিম ভারতের রক্তপ্রবাহ। তাছাড়া আর্য অনার্যের গ্যাঁড়াকলে খাবি খেতে খেতে সৃষ্ট ব্রাহ্মন ক্ষত্রিয় বৈশ্য শুদ্রের বর্ণ বৈষম্যে সামাজিক বিশৃংখলায় জর্জরিত উপমহাদেশের ইতিহাসেই তো আমরা খাবি খাচ্ছি অনন্তকাল ধরে। সেন পাল বা মৌর্যরা যেমন তাদের রাষ্ট্রীয় ও ব্যবহারিক জীবনে সংস্কৃত ভাষায় চলাফেরা করতেন তেমনি মির্জা শাহ খাঁ নামের মুসলিম শাসকরা উর্দু ফার্সী ভাষার তুরস্ক পারস্য ও আফগানস্তানের মানুষ ছিলেন। তবে একথা সত্য, সেন পাল বা মৌর্য - যারা বঙ্গ বিজয় করে বাঙালী সেজে এদেশ শাসন করেছিলেন তারা এখানকার আদি বাসিন্দাদের ( তাদের কথিত নম:শুদ্রদের) শাসন ও শোষন করার জন্যই এসেছে। শাসনকার্যের জন্য নিজস্ব দালান কোঠা বা দিঘি ফুল বাগিচাই ছিল তাদের বিচরনের গন্ডি। বাংলার কচুঘেচু খাওয়া সাধারন বাঙালী তাদের কাছে ছিল স্রেফ অছুৎ প্রজা। কিন্তু মুসলিম পীর ফকির ও যোদ্ধা শাসক যারা এসেছিলেন তারা এখানকার কাদা মাটির মানুষের আপনজন হয়ে এখানে স্থায়ী বসতি স্থাপন ক’রে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হন। বাংলার জনপদে ইসলামের প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের গোড়পত্তন মা, মাটি ও মানুষের সঙ্গে এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল।
এতশত কথা উচ্চারণ করা হোল স্রেফ একটি কারনে। এই যে আমাদের দেশে তার জন্মলগ্ন থেকে দেশ সমাজ রাজনীতি গণতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে হরহামেশাই খটমট লেগে থাকে বা আছে তার পোস্টমর্টেম করতে গিয়েই এতসব চিন্তা মাথায় কিলবিল করা শুরু করে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কেন আমরা হোমোজেনিয়াস বা একাত্ম হতে পারি না তার মূল এইসব বহুমুখী রক্ত প্রবাহের ফসল নয় কি? পাকিস্তানী পঁচিশটি বছরের অস্তিত্বে না হয় একটু আধটু পরাধীনতার আঁশুটে গন্ধ ছিল। নিজেদের মাটি ও মানুষের স্বকীয়তা বিনির্মানের একটা স্বচ্ছ্ব তাগিদ সেখানে ছিল। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল নেতৃত্বের নিখুঁত নিটোল বজ্রকন্ঠ ও তার প্রতি একাত্মতা। ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও বোধের এক অবিচল লক্ষ্যমাত্রা। বাঙলা ও বাঙালীর মা মাটি ও মানুষের জাতীয়তা বোধে তারা বাংলা মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। বাঙালী আপন অস্মিতায় মহীয়ান হয়েছে। কিন্তু গল্প তো এখান থেকেই শুরু। দেশ হোল। রাজনীতি এল। শাসক পেলাম। শাসন পেলাম। গণতন্ত্রের লড়াই চললো। কিন্তু ঐ যে বলেছি রক্ত প্রবাহ। এ মাটির গন্ধে বেড়ে উঠা মানুষগুলো! সবাই যেন সেই “আমরা সবাই রাজা”র ঢোল করতাল নিয়ে মাঠে নেমে পড়লো। উনারা ইয়েমেনী পীর বংশের অমুক। তেনারা বিহার পশ্চিম বংগের বা আসামের রিফিউজি, তাহারা পশ্চিম পাকিস্তানের চর এজেন্ট, কিংবা আমরা সপক্ষের আর বিরুদ্ধবাদীরা চেতনা বিরোধী মৌলবাদী দেশদ্রোহী ইত্যাদি। এধরনের হীনমন্য আওয়াজ তুলে রাজনীতির মাঠকে কলুষিত করনের মাধ্যমে আমরা আমাদের বাঙালী ঐতিহ্যের বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে যে যার মত নৃত্য করতে থাকলাম।
বাহান্ন থেকে একাত্তরের সংগ্রাম, গণ-অভ্যুত্থান বা মানুষজনের একাট্টা হয়ে স্বৈরাচার কিংবা বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। কিন্তু একাত্তর পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রাম বা সংঘটিত গণ অভ্যুত্থান হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব বিনির্মান ও টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। কিন্তু তারপরেও শংকিত হওয়ার কারনগুলো কি! ঐ যে বলা হোল রক্ত প্রবাহ ও আত্মরম্ভিতার সুক্ষাতিসুক্ষ গিঁটগুলো। সাধারন তৃণমূলের মানুষগুলো তো এই কাদামাটির মানুষ। হয়তোবা যারা রাজনীতি ও শাসন নীতির বাউন্ডারীতে বিচরন করেন তারাও। তবে এ মাটির ভূখন্ডে রাজা রাজনীতি ও শাসনের প্রবাহ এতই খরস্রোতা ছিল যে বাঙালী তার আপন অস্তিত্ব ও অস্মিতার স্বাদে কখনোই বিচরন করতে পেরেছে বলে কেউ হলফ করে বলতে পারবেন বলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এরই খেসারত দিতে গিয়ে কি আমরা আপন অস্মিতার স্বকীয়তা নিয়েও বার বার হোঁচট খাচ্ছি? স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়েও কেন আমরা এখনো ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সি’র মন্ত্রে উজ্জীবিত হতে পারছিনা। এত রক্ত এত প্রান দিয়েও কেন আজও আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অস্তিত্বে ফাটল বা ভাঙ্গনের আশংকায় শংকা প্রকাশ করি।
বুনিয়াদী আমল নামার পচা শেকড় বাকড় ও আগাছা নিড়ানীর সময় কি এখনো আসে নি?