জালাল উদ্দিন আহমেদ
মানবতার মূল্যবোধ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ নভেম্বর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:৫২ এএম, ৫ মে,রবিবার,২০২৪
মানুষের মনুষত্বই হচ্ছে সবচেয়ে বড় মন্ত্র যা নিয়ে মানবজাতির সর্বময় কল্যানে এগোনো যায়। তবে সবকিছুর মূলে রয়েছে তার মানবিক মূল্যবোধের জীবনাচার সম্বলিত সামাজিক অবকাঠামো। আর এই মূল্যবোধ ভিত্তিক জীবনাচার তখনই সার্থক হয়ে উঠে যখন সে সামাজিক শৃংখলে আবদ্ধ থেকে তার জন্য নির্দিষ্টকৃত ধর্মীয় অনুশাসনে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে। কিন্তু এখনকার দিনে ধর্মও কেমন যেন পানসে হয়ে গেছে বলে মনে হয়। কোন ধর্মকে ছোট না করেই বলছি, কারন আমার দৃঢ় বিশ্বাস পৃথিবীতে প্রতিটি ধর্মই এসেছে মানব জাতির বৃহত্তর কল্যানে। যদিও মানব জাতির কল্যানে সর্বশেষ স্বীকৃত ধর্ম ইসলামের ঐশী গ্রন্থ কোরান উল কারিমে মহান আল্লাহু তায়ালা ইহুদী জাতীয়তাবাদীদের অভিশপ্ত ও বাতিল বলে ঘোষনা দিয়েছেন। (সুরা নিসা, আয়াত:১৫৫, সুরা মায়েদা: আয়াত:৬৪)।
পৃথিবীতে ইসলাম, খৃষ্টান এবং ঈহুদী এই তিন ধর্মকে একত্রে আব্রাহামিক ধর্ম হিসাবে চিহ্নিত কর হয়। কারন হজরত ইব্রাহিম(আ:)কে এই তিন ধর্মই তাদের জাতির পিতা হিসাবে সম্মান দেয়। তিনটি ধর্মই তাঁকে আদি পিতা হিসাবে গণ্য করে। আল্লাহ রসুল নবী পয়গম্বর ইহকাল পরকাল এবং তাদের জন্য নাজিলকৃত ঐশী গ্রন্থগুলিও স্বীকৃত সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ঈহুদী জাতীয়তাবাদের কিছুআকাক কিছু গোষ্টি খুব উগ্র ও আধিপত্যবাদী এবং উচ্চাভিলাষী আচরনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। হজরত মুসা(আ:) এর অনুসারী হয়ে তারা ঈহুদীবাদে থেকেও কট্টর উগ্রবাদ নিয়েই এগোতে থাকে। তারা ভবঘুরে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খৃষ্টানদের সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এক সময় তারা প্যালেস্টাইনের জেরুজালেম সংলগ্ন পাহাড় জিওনকে কেন্দ্র করে শপথবদ্ধ হন এবং জেরুজালেম কেন্দ্রিক নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। ইহুদী ধর্ম সম্প্রদায়ের একটি কট্টর গোষ্ঠীই হলো জায়ন বা সিয়োন। এরা শপথবদ্ধ এবং প্রতিজ্ঞাত। এদেরই পুর্ব পুরুষের একটি গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে দ্বন্দে জড়িয়ে একসময় তাদেরই ধর্মগুরু পয়গম্বর হজরত মুসা(আ:)কে হত্যা করেছিল। এজন্যই তারা আল্লাহ ঘোষিত অভিশপ্ত জাতি। কালক্রমে এই জায়নবাদীদের প্রাধান্যে উগ্র ইহুদী জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তাদের ধারনায় ইসরাইল রাষ্ট্রটি হবে জেরুজালেম কেন্দ্রিক। একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীর অর্ধেকটা অর্থাৎ এশিয়া ইউরোপের পুরোটাই ইসলাম শাসনের অধীনে ছিল। তাছাড়া পুর্ব হতেই প্রতিষ্টিত আব্রাহামিক ধর্মের প্রচার প্রসারে দুনিয়াজোড়া বিস্তৃত হয় তার ব্যাপ্তি। উচ্চাভিলাষী ইহুদীরা নিজেদের একত্রিত হওয়া এবং নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিল। সেই ভষ্মে ঘি ঢেলে তা আরো উতপ্ত করেছিলেন অস্ট্রীয়ান এক ইহুদী জায়নিষ্ট থিউডর হার্জল। এভাবেই কাল পরিক্রমায় খৃষ্টান ইহুদী যৌথ প্রযোজনায় দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদীদের জেরুজালেম সংলগ্ন প্যালেস্টাইনে একত্রিত করে ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন ঘটানো হয়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিল পৃথিবীর রক্তচোষা জাতি ও শক্তি হিসাবে পরিচিত বৃটিশরা।
আমার এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবতা। গত সাত অক্টোবর হতে মধ্য প্রাচ্যের পালেস্টাইনের মাটিতে অমানবিক ও অনৈতিকভাবে মনুষ্য নিধনের যে রিহার্সাল চলছে সেটা নিয়েই আমার মনুষ্য ইনস্টিংটের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম সুতোগুলো প্রশ্ন করছে, কোন্ মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচবো আমরা। অভিশপ্ত ইসরাইলী ইহুদীদের দ্বারা ফিলিস্তিনীদের এই হত্যাযজ্ঞকে দুনিয়ার তথাকথিত উন্নত, সভ্য, শক্তিধর এবং কাগজ কলমের মানবতাবাদী রাষ্ট্রসমূহ যেভাবে উলঙ্গ সমর্থন জানাচ্ছে সেটাকে কিভাবে মেনে নেয়া যায়! শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের মদদ পুষ্ট হয়ে ফিলিস্তিনের মাটি দখলকারী এই জাতি যখন ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন ঘটালো তখন দুনিয়ার তাবড় শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ তাদের সমর্থন করে তড়িঘড়ি করে জাতিসংঘের সদস্য হিসাবে স্বীকৃতি এনে দিল। অথচ একই জমিনে পুর্ব প্রতিষ্ঠিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে তারা অগ্রাহ্য করলো। সেই থেকে ফিলিস্তিন নামক ভূখন্ডের মূল নিবাসী ফিলিস্তিনি মুসলমানেরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে মানবেতর জীবনে পতিত হোল। এসব নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহের সাথে কয়েকবার যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে। কিন্তু মাথার উপর ছাতা হয়ে যখন বৃটিশ মার্কিনীরা তাদের শতবর্ষীয় পরিকল্পনায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখন ক্ষুদ্র শক্তির প্রতিবেশীরা উল্টো নিজেদের শক্তি ও জমিন খুইয়ে পুচকে ইহুদীবাদী ইসরাইলকে স্ফীত করেছে। এবং সবকিছু সম্ভব হয়েছে মানবতার ধ্বজাধারী বৃটিশ মার্কিনীদের পাশার চালে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে চলা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে আমরা পক্ষ বিপক্ষ হয়ে অনেক বাদানুবাদ করি। সেই ইউক্রেনও এক সময় সংযুক্ত সোভিয়েত রাশিয়ার অংশ ছিল। স্নায়ু যুদ্ধের প্রবল চাপ এবং ধনবাদী রাষ্ট্র ন্যাটোভুক্ত দেশ সমূহের আরাম আয়েশ ও জৌলুশের মোহে সেই সংযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে বৃহত্তর রাশিয়াকে আলগা রেখে তারা জাতিগত রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখানেই ক্ষান্ত থাকেনি মার্কিনীদের চাল। তারা রাশিয়া হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া রাষ্ট্র সমূহকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার কৌশলে ন্যাটোকে বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক বলয়ে পরিনত করার নীল নক্সায় মেতে উঠে। তারা সুপার পাওয়ার হিসাবে বিবেচিত রাশিয়ার অতি কাছের প্রতিবেশী ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার নতুন উদ্যোগে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাশিয়া তার নিজস্ব নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করে ইউক্রেনকে প্রতিপক্ষের দলে ভিড়তে দিতে নারাজ। এই ধরনের পক্ষ বিপক্ষের দোলাচালে যখন ইউক্রেন ধনবাদীদের প্ররোচনায় অতি উৎসাহী এক বেপরোয়া আচরনে এগিয়ে যেতে চায় তখন রাশিয়া তার নিজের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ইউক্রেনকে শিক্ষা দেয়ার মানসিকতায় আক্রমন করে বসে। ফলে গত তিরিশ মাস ধরে ইউক্রেন রাশিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সেই জনপদে এখন আহাজারি চলছে। মধ্যখানে ধনবাদী গোষ্টী তাদের লক্ষ্য পুরনে মানবতার অজুহাতে সেখানে অস্ত্র ব্যবসার কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে গোটা ইউরোপ তথা পৃথিবী ব্যাপী বাবসা বানিজ্য ও অর্থনৈতিক মন্দাভাব মাথাচাড়া দিয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ও ইসরাইল দুটি আলাদা জাতিস্বত্তার রাষ্ট্র। যদিও ফিলিস্তিনি জমির উপর জবরদখল নিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন ঘটানো হয়েছিল। অথচ আজকের বাস্তবতায় ফিলিস্তিন কোন রাষ্ট্রই নয়। বরং দখলদার ইসরাইল এখনকার সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। আর নিজ ভূমিতে ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনিরা এখন রাষ্ট্রবিহীন জনপদের তকমা নিয়ে নামে মাত্র ফিলিস্তনি কর্তৃপক্ষ সেজে ইঙ্গো-মার্কিন দয়ায় ধুঁকছে। শুধু তাই নয় দখলবাজ ইহুদীরা ফিলিস্তিনের ভূখন্ড দখল করতে করতে এখনকার সময়ে তারা ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ৭০% জমিকে ইসরাইল রাষ্ট্রের মালিকানায় এনেছে। স্বাভাবিক নিয়মে ফিলিস্তিনিদের নিজ মাটির অধিকার চাওয়ার যৌক্তিকতা সার্বজনীন হওয়ার কথা। এবং সেই লক্ষ্যেই তারা সংগ্রাম করে যাচ্ছে যা দমন করার নামে ইসরাইল অমানবিক উপায়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ অন্দোলনের সামরিক শাখা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ইহুদীবাদীদের সাথে লড়াই করছে বটে তবে তা অসম যুদ্ধ বলেই ধরে নেয়া যায়। তারপরেও যুদ্ধংদেহী এই যুদ্ধবাজ ইসরাইলকে সমর্থন ও সহয়তার নামে আমেরিকা ও বৃটিশ সরকার প্রধানদ্বয় ইসরাইলে গিয়ে যে কায়দায় সমর্থন করে এলেন তাতে করে দুনিয়াতে মানবতা ও নৈতিক মূল্যবোধ বলে যে কোন শব্দ এবং তার প্রয়োগ প্রচলিত আছে তা নতুন করে ভাবতে হবে বৈকি!
গত এক মাস ধরে ছোট্ট একটি অবরূদ্ধ ভূখন্ডে গাদাগাদি হয়ে বাস করা বিশ বাইশ লাখ ফিলিস্তিনি সাধারন জনগনের উপর ইসরাইল বেপরোয়া ও অমানবিক উপায়ে বিমান আক্রমন করে শিশু ও নারী হত্যায় উন্মত্ত রয়েছে। যেভাবে ইসরাইল, বিমান আক্রমন করে তাদের হত্যা করছে তা বর্তমান সভ্য জগতের কোন্ আঙ্গিকে গ্রহনযোগ্য তা ভাবলেই অতংকিত হয়ে হয়। কেননা বৃহৎ শক্তির মোড়লরা যখন এই আক্রমন ও ধংসাত্মক কার্যক্রমে সরাসরি সহয়তা নিয়ে মাঠে অবতীর্ণ হয় তখন তৃতীয় বিশ্বের অসহায় আম জনতার আর বুঝতে বাকী থাকেনা যে মানব জগতের নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে। নিজের রুটি রূজির সুবন্দোবস্ত করে তৃতীয় বিশ্বের হাড় হাভাতে জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্র সমূহকে নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করা এই ইহুদী-খৃষ্টান বলয়ের খবরদারির নির্ঘন্টটি হয়তোবা উপরওয়ালা কর্তৃক নির্ধারিত হয়েই এই দুনিয়া জমিনের সৃষ্টি হয়েছে। নইলে এত এত অন্যায় অবিচার প্রকাশ্যলোকেই সংঘটিত হওয়ার পরও দৈব সৃষ্ট সেই "মাটি ফাঁক" করার গল্পটি কি গল্প হয়েই থাকবে! যে শক্তিমত্তা ও বিত্ত বৈভব নিয়ে তারা দুনিয়া জুড়ে তাদের মত করেই দুর্বার হয়েছে তাতে করে আমাদের মত হাড় হাভাতেদের অদৃষ্টবাদী হওয়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে! মানবতা ও নৈতিকতা কাগজ কলমের পাতাতেই সমৃদ্ধ থাকুক। আর তারা অর্থৎ বিশ্ব মোড়লরা তাদের সৃষ্ট সেই "চোরকে বল চুরি করতে আর গৃহস্থকে বল সামলে রাখতে" মন্ত্র নিয়ে দুনিয়া ভর তাদের মোড়ল মাত্ববরী বহাল রাখুক। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের হেফাজত করুন! আ'মীন!