avertisements 2

ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার তেল চাইছেন, এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের আসল লক্ষ্য

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৫ | আপডেট: ০৫:০৪ এএম, ১৩ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৫

Text

যুক্তরাষ্ট্র তেলের দখল চায় বলে দাবি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর। ফাইল ছবি: এএফপি

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো দাবি করছেন, তাঁর দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ানোর লক্ষ্য একটাই- বিশাল তেল সম্পদের দখল নেওয়া। 

চলতি সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার জব্দ করে। অভিযোগ করা হয়, এতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভেনেজুয়েলার তেল বহন করা হচ্ছিল। এরপরই হোয়াইট হাউস সতর্ক করে, ভেনেজুয়েলার তেল বহন করলে অন্য জাহাজের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগে ভেনেজুয়েলার কয়েকটি নৌকা লক্ষ্য করে মার্কিন সামরিক হামলার ঘটনা ঘটে। যেগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র মাদক পাচারের জাহাজ হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যেই মাদুরোকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে অভিযোগ করেছেন, ভেনেজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রে মাদক ও অপরাধী পাঠাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো ট্রাম্প কি আসলেই ভেনেজুয়েলার তেল চান? দেশটির তেল কি লাভজনক পর্যায়ে আছে?

ভেনেজুয়েলার তেলের পরিমাণ কত

এটা সত্য যে, ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল ভাণ্ডারের মালিক। দেশটির মাটির নিচে আনুমানিক ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেল আছে, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি। কিন্তু ভাণ্ডারে মজুতের তুলনায় উৎপাদন খুবই কম।

২০০০ সালের শুরু থেকে উৎপাদন প্রবলভাবে কমতে থাকে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ ও পরে নিকোলাস মাদুরো রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পিডিভিএসএ- এর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোর করতে থাকেন। এতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বড় অংশ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যান। যদিও মার্কিন জায়ান্ট শেভরনসহ কিছু পশ্চিমা কোম্পানি এখনো ভেনেজুয়েলায় কাজ করছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়েছে। তেল রপ্তানিকে লক্ষ্য করে মাদুরো সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক লাইফলাইনও দুর্বল করার চেষ্টা করছে।


২০১৫ সালে বারাক ওবামা প্রশাসন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রথম নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর ট্রাম্প যুগে তা বহুগুণে কড়া হয়েছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যে নেমে আসে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি আমদানি করো কঠিন হয়ে পড়ে। 

ইনভেস্টেকের কমোডিটি প্রধান ক্যালাম ম্যাকফারসনের মতে, ‘ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলনের মূল সমস্যা হলো তাদের অবকাঠামোর ভগ্নদশা।’ আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত নভেম্বরে ভেনেজুয়েলা প্রতিদিন তেল উৎপাদন করেছে মাত্র ৮ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল। এক দশক আগের পরিমাণের তুলনায় এটি এক-তৃতীয়াংশেরও কম। বিশ্বব্যাপী দৈনিক যে পরিমাণ তেল ব্যবহার হয়, সেই চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের মাত্রা ১ শতাংশের নিচে।

ট্রাম্প কি আসলেই তেলের প্রতি আগ্রহী
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও এমন ধারণা আছে যে, ভেনেজুয়েলায় হস্তক্ষেপ করলে মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন সুযোগ পেতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ও ফ্লোরিডার রিপাবলিকান নেত্রী মারিয়া এলভিরা সালাজার সম্প্রতি ফক্স বিজনেসকে বলেছেন, ভেনেজুয়েলা হতে পারে আমেরিকান তেল কোম্পানির জন্য এক স্বর্ণখনি। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো দেশটিতে গিয়ে তেলের নষ্ট হয়ে পড়া পাইপলাইন, রিগসহ পুরো অবকাঠামো মেরামত করতে পারবে। 

এমন যুক্তির প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আগ্রহী বলে মনে হতে পারে। কারণ তাঁর প্রচার কর্মসূচির স্লোগানই ছিল ‘ড্রিল, বেবি, ড্রিল’। যা বোঝায় তিনি সামগ্রিকভাবে তেল উৎপাদন বাড়ানোর পক্ষে। এবং আমেরিকানদের জন্য তেলের কম দাম নিশ্চিত করতে চান।

তবে হোয়াইট হাউস বলছে, ভেনেজুয়েলা নিয়ে তাদের উদ্বেগ মূলত মাদক পাচার ও মাদুরোর ‘অবৈধ’ শাসনকে ঘিরে। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিটের কাছে জানতে চাওয়া হয়- যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান কি শুধু মাদক পাচার প্রতিরোধের জন্য, নাকি ভেনেজুয়েলার তেল লক্ষ্য করে। জবাবে লেভিট বলেন, প্রশাসন অনেক বিষয়েই মনোযোগ দিচ্ছে। মাদক পাচার বন্ধ করাটাকে যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে দেখছে।

থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্বালানি নিরাপত্তাবিষয়ক সিনিয়র ফেলো ক্লেটন সিগল বলছেন, তিনি এসব ঘোষণাকে সরলভাবেই দেখেন। অর্থাৎ, যা বলা হচ্ছে সেটিকেই উদ্দেশ্য হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।

মার্কিন প্রভাবশালী নেতাদের একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তাঁর আগ্রহের দিকে ইঙ্গিত করে ক্লেটন বলেন, তেল-ই যে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙক্ষার কেন্দ্রবিন্দু- এখনো সেটির প্রমাণ দেখা যায়নি। 

তাহলে আগ্রহ কী নিয়ে
এমন নয় যে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন স্বার্থ নেই। দেশটির তেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে কেবল শেভরনই বর্তমানে ভেনেজুয়েলায় সক্রিয়। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিশেষ অনুমতি দেয়। ট্রাম্প প্রশাসনও চলতি বছর শেভরনের ছাড়পত্র নবায়ন করেছে। তবে স্পেনের রেপসোলসহ অন্য বিদেশি কোম্পানির বিশেষ ছাড় বাতিল করা হয়েছে। এর লক্ষ্য মাদুরো সরকারের হাতে অর্থের প্রবাহ সীমিত করা। 

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার মোট তেল উৎপাদনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই হয় শেভরনের মাধ্যমে। বিশ্লেষকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে পারে শেভরন। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা, অবকাঠামো ও স্থানীয় নেটওয়ার্ক দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করবে। অপরদিকে মার্কিন উপসাগরীয় অঞ্চলের পরিশোধনকারীরাও দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলার ‘ভারী’ অপরিশোধিত তেলের দিকে নজর রাখছেন। এ ধরনের তেল সাধারণত সস্তা হয়। ফলে পরিশোধন করাটা লাভজনক।

তথ্য বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান কেপলারের তেল বিশ্লেষক ম্যাট স্মিথ বলছেন, ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা এই পরিশোধনকারীদের কাছে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারী অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ কমে গেছে। এই পরিশোধনকারীরা উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও, এমন তেল কেনার বিষয়ে তাদের আগ্রহ আছে।

চ্যালেঞ্জগুলো কী
ভেনিজুয়েলার তেল রপ্তানি বাড়লে তা যুক্তরাষ্ট্রে দাম কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি সময়সাপেক্ষ। কারণ বর্তমান উৎপাদন এতটাই সীমিত যে তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারবে না।

ভেনেজুয়েলার তেল শিল্পকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াটাও সহজ কাজ নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও কিছু বিনিয়োগ করা গেলে আগামী দুই বছরে ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন প্রতিদিন প্রায় দুই মিলিয়ন ব্যারেল পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।

তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, উৎপাদন আরো বেশি বাড়াতে কয়েক কোটি ডলার এবং প্রায় এক দশকের মতো সময় লাগতে পারে। তা ছাড়া, ইরান, ইরাক, কাতার ও সৌদি আরবের সঙ্গে ভেনেজুয়েলাও পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারকদের সংস্থার (ওপেক) সদস্য। এটিকে তেল উৎপাদন ও বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো জটিলতার কারণ মনে হতে পারে। 

ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের ক্লাইমেট ও কমোডিটিজ বিভাগের প্রধান ডেভিড অক্সলে বলছেন, ঝুঁকির আরেকটি বিষয় আছে। সেটি হলো তেলের ভবিষ্যৎ চাহিদা। কারণ, জ্বালানির উৎস হিসেবে এর গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমছে। তেলের চাহিদা হয়তো হঠাৎ করেই কমবে না। তবে এর বৃদ্ধির গতিও আগের মতো নেই। ফলে ভেনেজুয়েলার তেল খাতে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে আগে দেখবে- এটি লাভজনক কিছু বয়ে আনবে কি না।

ডেভিড অক্সলে বলেন, যদি মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো উঠে যায়, তবুও প্রশ্ন থাকে- কোম্পানিগুলো দেশটিতে তেল উৎপাদনে সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করতে কতটা প্রস্তুত।
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2