কৃষকের ৪ টাকার আলুর কেজি বাজারে কেন ২০?
                                    
                                    
                                        
                                            ডেস্ক রিপোর্ট
                                        
                                    
                                   
                                     প্রকাশ:  ১২:০০ এএম,  ১৫ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট:  ০৪:২২ পিএম,  ৪ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৫
                                
                        
                    দেশের সর্ববৃহৎ আলু উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে পরিচিত রংপুরে মৌসুমের শুরুতে চার টাকায় নেমেছে আলুর কেজি। এত কম দামে আলু বিক্রি করে প্রচুর লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে চার টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করে দিশেহারা কৃষকরা। চালান তোলা তো দূরের কথা, ক্ষেত থেকে আলু তুলে ভ্যানভর্তি করে বাজারে আনার খরচই উঠছে না তাদের।
 
এদিকে, খুচরা বাজারে এখনও প্রতিকেজি আলু ২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কৃষকের কাছ থেকে চার টাকা কেজিতে আলু কিনে লাভবান হচ্ছেন পাইকার, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। অথচ আলু চাষ করে মাথায় হাত কৃষকের।
 
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রংপুর জেলায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে আলু চাষ হয়েছে। এ বছর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৫৩ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমি। অথচ এবার অতীতের রেকর্ড ভেঙে আলু চাষ হয়েছে ৫৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। যা দেশের মোট চাহিদার চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি।
 
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা আগাম আলু চাষ করেছেন। লাভের আশায় বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে খরচ পড়েছে ১২ থেকে ১৫  হাজার টাকা। সেখানে এক বিঘা জমির আলু বিক্রি করে ১০ হাজার টাকাও উঠেছে না। গত বছর আগাম আলু চাষিরা প্রতিকেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি করতে পারলেও এবার চার-পাঁচ টাকায় বিক্রি করছেন। 
 
পাশাপাশি কার্ডিনাল আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১১ টাকা। যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৪০ টাকা। আলুর দাম না পাওয়ায় রংপুরের হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছেন না তারা। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় বেশি চাষ হওয়ায় মহাজনরাও আলু নিতে আগ্রহী না। ফলে পানির দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। 
 
রংপুর সদর উপজেলার পালিচড়া গ্রামের সাদেকুল ইসলাম ও তার ভাই আমিনুল ইসলাম ছয় বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু আলু বিক্রি করতে পারছেন না। প্রতিকেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে আট টাকার ওপরে। এখন সেই আলু চার-পাঁচ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন।
 
তারা জানান, প্রতিবছর আলু ক্ষেতে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে আলু কিনে নিয়ে যেতেন। অগ্রিম টাকাও দিতেন। কিন্তু এবার পাইকারের দেখা নেই। এনজিও থেকে সুদে টাকা নিয়ে আলু চাষ করেছি। এখন টাকা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
 
একই কথা জানালেন আক্কেলপুর গ্রামের আলু চাষি মমেনা বেগম ও সাহেব আলী। তারা বলেন, চার টাকা আলুর কেজি। এর চেয়ে সস্তা আর কিছুই নেই। এভাবে চললে আগামীতে আলু চাষ করবো না।
 
রংপুরের পাইকারি সবজির বাজার পালিচড়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা আলুর মণ বিক্রি করছেন আড়তদাররা। হিসাবে কেজি পড়ে আট থেকে নয় টাকা। মূলত পাইকারদের কাছ থেকে আলু কিনেন আড়তদাররা।
 
কৃষকদের কাছ থেকে চার টাকা কেজিতে আলু কিনে আড়তদারদের কাছে ছয়-সাত টাকা বিক্রি করেন পাইকাররা। তারা জানান, আলু কেনার পর পরিবহন ও শ্রমিক খরচসহ দুই-তিন টাকা খরচ বেশি পড়ে। এজন্য ছয়-সাত টাকায় বিক্রি করতে হয়।
 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর নগরীর আলুটারী, মাহিগঞ্জ, নবদীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় আলু চাষ বেশি হয়। প্রতি বিঘায় আলু চাষে ১২ থেকে ১৫  হাজার টাকা খরচ হয়। এরমধ্যে অনেকেই আগাম আলু চাষ করেন। তারা আগে তুলে আগে বিক্রি করে দেন। আবার অধিকাংশ চাষি আলু পরে তোলেন। এগুলো নিজেদের বাড়িতে সংরক্ষণ করেন কেউ কেউ, আবার অনেকেই হিমাগারে রেখে দেন। দাম বাড়লে তখন বিক্রি করেন। কিন্তু আগাম আলু হিমাগারে রাখলে পচন ধরে।
 
মাহিগঞ্জ এলাকার আলু চাষি জাহেদুল ইসলাম ও ওসমান আলী জানান, এবার আগাম আলু উৎপাদন করে ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে। এবারের মতো কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হইনি আমরা।
 
যেভাবে ৪ টাকার আলু ২০ টাকায় কেজিতে বিক্রি হয়:
প্রথমে আলু চাষি থেকে পাইকারি, এরপর পাইকারি থেকে ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীর হাত থেকে খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হওয়ার এই প্রক্রিয়ায় চার দফা দাম বাড়ে। ফলে কৃষকের চার টাকার আলু ভোক্তাকে ২০ টাকায় কিনতে হয়।
আলুর বাজার অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ক্ষেত থেকে আলু তুলে বাজারে এনে পাইকার কিংবা আড়তদারের কাছে চার-পাঁচ টাকা কেজি বিক্রি করেন একজন চাষি। সেই আলুর কেজি ছয়-সাত টাকায় আড়তদারের কাছে বিক্রি করেন পাইকার। এই আলু ব্যবসায়ীর কাছে নয় থেকে ১০ টাকা বিক্রি করেন আড়তদার। ব্যবসায়ী সেই আলু নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন ১৩ থেকে ১৪ টাকায়। খুচরা ব্যবসায়ী সেই আলুর কেজি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন ২০ টাকা। তবে চাহিদা অনুযায়ী একটু কমবেশিতেও বিক্রি হয়। 
 
এ ব্যাপারে শহরের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, আমরা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনি না। আমরা সবজির পাইকারি হাট থেকে আলু কিনি। সেখান থেকে কিনে আনার পর পরিবহন খরচ, কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া, কুলি খরচসহ সব মিলিয়ে কেজিতে এমনিতেই দুই থেকে তিন টাকা বেশি পড়ে। এজন্য নয় থেকে ১০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়। এখানে আমাদের সীমিত আয়।
 
তিনি বলেন, মূলত আমাদের কাছ থেকে আলু নিয়ে ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করেন। তবে চারবার দাম বাড়ে এটা সত্য। এজন্য ভোক্তাদের একটু বেশিই খরচ পড়ে। পাশাপাশি কম দাম পাওয়ায় কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দাম আরেকটু বাড়লে তাদের ক্ষতি কমে আসবে। 
 
কৃষি বিভাগের ভাষ্য:
 
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, এবার রংপুরে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আবহাওয়া ভালো হওয়ায় রোগবালাই না থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে আগাম আলুর চাষ বেশি হওয়ায় কৃষকরা দাম পাচ্ছেন না। খুব কম দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
 
তিনি বলেন, গত বছর দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ টনের বেশি। চাহিদা ছিল ৮০ লাখ টন। চাহিদা পূরণ হওয়ার পরও অতিরিক্ত ৩৫ লাখ মেট্রিক টন আলু থেকে গেছে। রংপুরে চলতি মৌসুমে ৫০০ কৃষককে বিদেশে রফতানি উপযোগী আলু চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫  লাখ টন আলু রফতানি করা গেলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পাবেন। সেজন্য বিদেশি গ্রাহকদের চাহিদাসম্পন্ন আলু উৎপাদন করতে হবে। সরকারিভাবে হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। রংপুরে যে হারে আলুর উৎপাদন বেড়েছে, যদি এভাবে লোকসান গুনতে থাকেন তাহলে আলু চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন কৃষকরা। এ জন্য রফতানি করতে হবে।


                                    
                                    
                                    
                                    
                                    


