avertisements 2

২০২০ সালের বিশ্বচিত্র যেমন ছিলো

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৬:০৪ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২০ | আপডেট: ০৯:৩৩ এএম, ২৩ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

ব্যস্ত সব শহর শুনশান, বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দি, জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরোনো মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক; চলছে না গাড়িঘোড়া, ট্রেন-বিমান নিশ্চল, হাসপাতালে উপচে পড়া রোগীর ভিড়, মর্গে সারি সারি মৃতদেহ- করোনাভাইরাস মহামারীতে চলতি বছর বিশ্বের অসংখ্য দেশ, শহর-নগরকে নতুন এ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

প্রাণঘাতী, ছোঁয়াচে ভাইরাসের দাপটে ত্রস্ত পৃথিবীতে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে বিভিন্ন দেশের সরকার ও কর্তৃপক্ষকে হতে হয়েছে কঠোর; ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে হয়েছে, অবরুদ্ধ করে দিতে হয়েছে একের পর এক এলাকা। বেশিদিন এভাবে চালানো না যাওয়ায় বদলাতে হয়েছে কৌশলও। তবে কোনও কিছুতেই থামানো যায়নি মৃত্যুর মিছিল।

বছরের শেষদিকে বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিষেধক আসার খবর খানিকটা স্বস্তি দিলেও বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সংক্রমণের নতুন নতুন ঢেউ, তা ঠেকাতে ফের বিধিনিষেধ, সঙ্গে করোনাভাইরাসের আরও আক্রমণাত্মক নতুন ধরনের প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়ে এখনও কোভিড-১৯ এর আতঙ্ক জারি রেখেছে।

মহামারীর এ বিশ্বে মাস্কে ঢাকা মুখই এখন পরিচিত দৃশ্য; হাত ধোয়া, সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভিড় এড়িয়ে চলার মতো নানা বিধি মেনে চলার পাশাপাশি লকডাউন, কারফিউ, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, হার্ড ইমিউনিটি, প্রণোদনা, আয়-বৈষম্য- এ শব্দগুলো এখন অতি চেনা।

মহামারীর আতঙ্ক আর মৃত্যুর মিছিল, যাবতীয় অন্য সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে। হাসপাতালে আইসিইউ স্বল্পতায় ইউরোপে বেছে নিতে হয়েছিল কাকে বাঁচানো যাবে, আর কাকে না- সব মিলিয়ে চলতি বছরকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বছর বলছেন সাংবাদিক নিক ব্রায়ান্ট। কেউ কেউ আবার ২০২০ কে চিহ্নিত করতে চাইছেন আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর তটস্থ একটি বছর হিসাবে।

বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগনসহ বিভিন্ন রাজ্যে ভয়াবহ দাবানল, বিশ্বজুড়ে একের পর এক শক্তিশালী ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, পরিবেশ বিপর্যয় জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদকে নতুন করে হাজির করেছে। সেসময় বিশ্ব নেতাদের তৎপরতা তেমন আশা না জাগালেও বছরের শেষে এসে চীনের কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার প্রতিশ্রুতি ও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার রদবদল আগামী বছরগুলোতে এক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

এবছরই রাজপরিবার ছেড়েছেন ব্রিটিশ প্রিন্স হ্যারি ও তার মার্কিন স্ত্রী মেগান মার্কল। দায়িত্বের পাশাপাশি রাজকীয় উপাধিও ত্যাগ করেছেন তারা। চীনের মহাকাশযানের চাঁদ থেকে মাটি ও পাথর নিয়ে আসা এবং স্পেসএক্সের যানে দুই নভোচারীর কক্ষপথে যাওয়ার ঘটনাও চলতি বছর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।


ইন্দোনেশিয়ায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দুই স্বাস্থ্যকর্মী। ছবি: রয়টার্সইন্দোনেশিয়ায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দুই স্বাস্থ্যকর্মী। ছবি: রয়টার্সএমন এক বছরেও পৃথিবীতে যুদ্ধ-সংঘাতের কমতি ছিল না, ছিল জঙ্গি হামলাও। লাদাখে ভারত-চীন সংঘাত, নাগোরনো-কারবাখকে ঘিরে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ, তিগ্রাইয়ে ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনীর অভিযান বিশ্বজুড়ে সামনের দিনগুলোতে আরও অস্থিরতার শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন মিত্র মুসলিম দেশগুলোর প্রকাশ্যে একজোট হওয়ার পদক্ষেপ ওই অঞ্চল ঘিরে আগামীতে বড় ধরনের যুদ্ধের পটও প্রস্তুত করেছে।


ব্রঙ্কসের হার্টল্যান্ডে গণকবরে থরে থরে সাজানো কফিন। ছবি রয়টার্সেরমহামারীতে ওলট-পালট বিশ্ব

গত বছরের শেষদিকে চীনের উহানে যে রহস্যজনক ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছিল, তা যে মাত্র কয়েক মাসেই পৃথিবীর সব কোণে ছড়িয়ে পড়বে আর পুরো দুনিয়াকে ওলট-পালট করে দেবে তা সম্ভবত কারও দুঃস্বপ্নেও ছিলনা। প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস মহামারী হয়ে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের শরীরে পৌঁছে গেছে; প্রাণ নিয়েছে লাখ লাখ মানুষের।

সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রথম দিকে চীনের অনুসরণে কঠোর লকডাউনের পথে হাঁটলেও অনেক দেশ পরে অর্থনীতি বাঁচাতে সেখান থেকে সরে এসে নানামাত্রিক বিধিনিষেধের মাধ্যমে আক্রান্ত কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়। সঙ্গে চলে চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার, প্রতিষেধক বা টিকা তৈরির তোড়জোড়।

আতঙ্কের পাশাপাশি নতুন এ ভাইরাসের চরিত্র ও গতিপ্রকৃতি অজানা থাকায় প্রথম দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নানামাত্রিক নির্দেশনা দেশে দেশে বিভ্রান্তিরও জন্ম দিয়েছিল। সবাইকে মাস্ক পরার নির্দেশনা দিতে অনেক দেরি করায় আন্তর্জাতিক এ সংস্থার বিরুদ্ধে সমালোচনাও কম হয়নি।

সংস্থাটির বিরুদ্ধে চীনের তাঁবেদারি করার অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র; সম্পর্কও ছিন্ন করে। কেবল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বাঁকা চোখে দেখাই নয়, করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পেছনেও যুক্তরাষ্ট্র ও এর অনেক মিত্রই চীনকে দায়ী করে। বেইজিং তা অস্বীকার করে পাল্টা দায় চাপালে শুরু হয় কথার লড়াই।

ট্রাম্প কথিত এই ‘চীনা ভাইরাসের’ কারণে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক, ইউরো, কোপা আমেরিকাসহ একের পর এক আয়োজন পিছিয়ে দিতে হয়; জরুরি সভা বা সম্মেলনগুলো চলে যায় অনলাইনে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ফুলেফেঁপে ওঠে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য।

মহামারী আর নানান বিধিনিষেধের কারণে বেড়েছে ছাঁটাই, চাকরিচ্যুতি। আয় বৈষম্য বাড়ায় কোটি কোটি লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে; উল্টোদিকে সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকে বাড়িয়ে নিয়েছেন সম্পদের পরিমাণ। প্রাণঘাতী এই কোভিড-১৯ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দগদগে ঘা উন্মোচন করেছে; সুরক্ষা উপকরণ সংক্রান্ত নানান দুর্নীতিও অনেক দেশের রাজনীতিতে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে।

বছরের শেষদিকে এসে বেশ কয়েকটি দেশে টিকার প্রয়োগ আশা জাগালেও ধনীদের টিকার মজুদে দরিদ্র দেশগুলোর বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া কোনও টিকাই দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দিতে সক্ষম প্রমাণিত না হওয়ায় হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, ভিড় এড়িয়ে চলার মতো নির্দেশনায় তাই শিথিলতা দেখানো যাচ্ছে না। সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি বিবেচেনায় নানামাত্রিক বিধিনিষেধ আরোপের পথও তাই আরও অনেকদিনই খোলা থাকছে।


যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পের হার

চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকেও বিশ্বজুড়ে অনেকেই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। মহামারীর মধ্যে এ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হলেও এখন পর্যন্ত তিনি হার স্বীকার করে নেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিশংসনের মুখে পড়েও সিনেটের জোরে ক্ষমতায় বহাল থাকা এ রিপাবলিকানের পরিণতি যে এমন হবে বছরের শুরুতেও তা মনে হয়নি।

কিন্তু কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ব্যর্থতা, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পুলিশ নির্যাতন ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন, শ্বেতাঙ্গদের আস্ফালন, মহামারীর কারণে অর্থনীতির বেহাল দশা- এসবই চার বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ রাজনীতিবিদের দম্ভ চূর্ণ করে দিয়েছে।

নির্বাচনী প্রচার সমাবেশগুলোতে করোনাভাইরাসজনিত সুরক্ষা না মানা, হোয়াইট হাউজে অস্থিরতা, প্রভাবশালী অনেক রিপাবলিকানের বিরোধিতাও ট্রাম্পের জন্য কাল হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সী এ প্রেসিডেন্ট অবশ্য দায় চাপাচ্ছেন ‘ভোট কারচুপির’ ওপর। তার কথা, মহামারীর সুযোগে ডাকযোগে যে বিপুল সংখ্যক ভোট পড়েছে, তাতে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। ভোটে ট্রাম্পের পরাজয়ও নিশ্চিত হয়েছে মেইল ইন ভোট গণনার পর।

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, তিনি ট্রাম্প আমলের উল্টোপাল্টা নীতি বদলে যুক্তরাষ্ট্রকে ফের বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে নিয়ে যাবেন। নারী, কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী ও ল্যাটিনোদের প্রাধান্য দিয়ে গঠিত তার প্রশাসনও যুক্তরাষ্ট্রের বহুত্ববাদ ও উদারনৈতিকতার পুরনো রূপে ফেরারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বেড়েছে চীনের প্রভাব

তাইওয়ান উপকূলের কাছে চীনের যুদ্ধজাহাজ ও বোমারু বিমানের ধারাবাহিক উপস্থিতি আগের বছরগুলোর মতো ২০২০-এও দেখা গেছে; দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটির প্রভাবও এ মুহুর্তে একচেটিয়া।

বেইজিংকে ঠেকাতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপান-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া মিলে ‘কোয়াড’ গঠন করলেও ট্রাম্পের পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র এখন আর এই জোটকে এগিয়ে নেবে কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে। উল্টো বছরের শেষে মার্কিন মিত্র বেশ কয়েকটি দেশকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য জোট করে ওয়াশিংটন আর নয়া দিল্লিকেও চমকে দিয়েছে শি জিনপিংয়ের দেশ।

হংকংয়ে গত বছরের সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় বানানো নতুন নিরাপত্তা আইনে গণতন্ত্রপন্থি নেতাকর্মীদের একের পর এক জেলে ভরে শহরটিকে ফের বশে আনার কাজ অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে চীন। উইঘুরে তাদের নিপীড়ন নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন চলতি বছরও ছিল বেশ সরব, এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়তে হয়েছে তাদের।

তাইওয়ানে এ বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতা পশ্চিমাপন্থি সাই-ইং ওয়েনকে বেইজিংয়ের হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদারে একের পর এক পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। চীনের সঙ্গে নিজেদের আনুষ্ঠানিক নামে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায় স্বশাসিত এ দ্বীপটি চলতি বছর তাদের পাসপোর্টের নকশা বদলে ফেলারও ঘোষণা দেয়।

চীনের ৫জি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহ ও আপত্তি প্রযুক্তি জগতে তাদের অবস্থানকে খানিক নড়বড়ে করে দিলেও সারা দুনিয়ায় তাদের বৃহৎ বাজারকে খুব একটা চাপে ফেলতে পারেনি, পারেনি তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কমাতে। উল্টো যুক্তরাষ্ট্র যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে, চীন সেখানে নিজেকে বিশ্ব নেতার আসনে বসানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

বাণিজ্যে শুল্ক যুদ্ধ নিয়ে বছরের শুরুতে ওয়াশিংটন-বেইজিং একটি প্রাথমিক চুক্তিতে উপনীত হলেও পরের দিকে দুই পক্ষের সম্পর্কের কেবল অবনতিই দেখেছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের নানান নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় এ বছর চীনকে চোখে চোখ রেখে জবাব দিতেও দেখা গেছে।


বাগদাদের অত্যন্ত সুরক্ষিত গ্রিন জোনের প্রবেশ পথ। ফাইল ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যে আরও সংঘাতের চোখরাঙানি

বছরের শুরুতে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানি কমান্ডার কাসেম সোলেমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন যুদ্ধের দামামাই বাজিয়ে দিয়েছিল। ইরাকে মার্কিন সেনাদের ঘাঁটিতে তেহরানের পাল্টা হামলা আর কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার হুংকার টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল; যদিও ইরানি কর্মকর্তারা ক্ষেপণাস্ত্র ভেবে যাত্রীবাহী একটি বিমান ভূপাতিত করার পর তা থিতিয়ে আসে।

তেহরানকে ঠেকাতে এবছর হোয়াইট হাউস বেশ কয়েকটি আরব দেশকে তেল আবিবের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছে। এতে যে সৌদি আরবেরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে তেল আবিবগামী বিমানের জন্য পথ করে দিয়ে রিয়াদ তারই ইঙ্গিত দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এমন মেরুকরণ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের লালিত স্বপ্নকেও অনেক দূরে সরিয়ে দিল বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

এ বছরও ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুতিরা সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে একের পর এক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ইরাক, লেবাননে বেড়েছে তেহরানের প্রভাব। সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ আসাদের হাতে থাকলেও দেশটিতে ইরানের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েলি হামলা ছিল অব্যাহত। লেবানন এবং আশপাশের অঞ্চলে হিজবুল্লাহর দাপটও তেল আবিবের মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা তালেবানদের পাশাপাশি ইরানের জন্য শাপে বর হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। সৌদি জোটের সঙ্গে কাতারের দূরত্ব কমে আসার ইঙ্গিত মিলেছে; তবে এরপরও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। ইসরায়েল- রিয়াদ মিত্রতা বিবেচনায় নিলে ওই অঞ্চলে যে সামনের দিনগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি আরও বাড়বে, বছরের শেষভাগে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানি খুনের ঘটনা যেন তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দুর্ঘটনা, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে নাকাল বিশ্ব

ঘোর মহামারীর মধ্যেও অঘটন, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বরাবরের মতোই এবছরও নাকাল হয়েছে বিশ্ব। অগাস্টে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ভিডিও পুরো দুনিয়াকে আতঙ্কিত করেছে। ওই ঘটনায় দুই শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। মজুদ রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের এ ঘটনা যেন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞে মানুষ আর পৃথিবীর কী পরিণতি হতে পারে।

মহামারীর বিশ্বে আরও অনেক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বিশ্ববাসী; ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ নানান দুর্যোগ আর এসবের কারণে মানুষের প্রাণহানি ও বাস্তুচ্যুতি। যুক্তরাষ্ট্রের পিঠটানে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতিও দেখা যায়নি।

চলতি বছর ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশে আছড়ে পড়া সাইক্লোন আম্পান শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়; টাইফুন বাভিতে উত্তর কোরিয়ায় ভয়াবহ বন্যা, টাইফুন হাইশেন আর অক্টোবরে ফিলিপিন্সে আঘাত হানা শক্তিশালী ঝড় গনিও বিশ্ব গণমাধ্যমের মনোযোগ পায়।

মে মাসে সোমালিয়ায় হঠাৎ বন্যায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়। চীনে বছরের মাঝামাঝি বন্যায় নিখোঁজ ও মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪১-এ। ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় ভারত ও নেপাল মিলিয়ে মৃত্যু হয় ১৮৯ জনের। এজিয়ান সাগরে অক্টোবরের ৭ মাত্রার ভূমিকম্প গ্রিস ও তুরস্কে ৮১ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। জুনে মেক্সিকোতে আঘাত হানা ৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প ৬৪০ কিলোমিটার দূরের এলাকাকেও কাঁপিয়ে দেয়।

চলতি বছর চীনের বেশ কয়েকটি খনিতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। মিয়ানমারের কাচিনে জেড পাথরের খনিতে ভূমিধসের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৭৪ জনের। ইরানে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ১৭৬ আরোহীর সবার মৃত্যুর পর মে মাসে পাকিস্তানের আবাসিক এলাকায় আছড়ে পড়া একটি বিমানের ৯৯ আরোহীর ৯৭ জনের মৃত্যু হয়।

অগাস্টে কেরালায় এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে মৃত্যু হয় ১৯ জনের। এছাড়াও, চলতি বছর ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তমে একটি রাসায়নিক প্ল্যান্ট থেকে গ্যাস লিকেজের ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ৫ হাজারের বেশি মানুষ।

আর্কটিক সার্কেলের ভেতর সাইবেরিয়ার নরিলস্ক শহরের কাছে আমবারনায়া নদীতে ২০ হাজার টন তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় মে’তে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে জরুরি অবস্থাও জারি করতে হয়। মরিশাসের প্রবালপ্রাচীরে আটকে যাওয়ার পর ভেঙে পড়া জাপানি নৌযান ওয়াকাশিও থেকেও প্রায় ১ হাজার টন তেল সমুদ্রে ছিটকে পড়ে।

ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী অনেক নৌকা ডুবি ও প্রাণহানিরও ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরও। অক্টোবরে সেনেগাল উপকূলের কাছে এমনই এক ঘটনায় অন্তত ১৪০ অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম।

বেহাল বিশ্ব অর্থনীতি

মহামারী আতঙ্কে গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে পড়ায় বছরের শুরুতেই বিশ্ব অর্থনীতি পড়ে তুমুল চাপে। বিভিন্ন দেশ সেসময় লকডাউন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ সব বন্ধ করে দিলেও পরে মহামারীর মধ্যেই ধীরে ধীরে জরুরি সব কার্যক্রম চালু করতে বাধ্য হয়।

এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানায়, মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছে। ১৯৩০-র মহামন্দার পর এমনটা আর হয়নি।

মহামারীতে অর্থনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে অন্যতম ছিল বিমান যোগাযোগ ও পর্যটন। মে’তে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় ¬এয়ার ক্যারিয়ার ল্যাটাম এয়ারলাইন্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে। অসংখ্য কোম্পানিতে বিপুল সংখ্যক ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতি দেখা দেয়।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশ নানান প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়িয়ে যায় ট্রিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ে ইউরোপের নেতারাও মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ৭৫০ বিলিয়ন ইউরোর তহবিল সৃষ্টিতে একমত হন।

পানামা ফাইল, প্যারাডাইস পেপার্সের ধারাবাহিকতায় এ বছর মেলে ফিনসেন ফাইলসের খোঁজ। টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলো গত দুই দশকে বিপুল অংকের সন্দেহজনক তহবিল লেনদেন করেছে বলে বেরিয়ে আসে নতুন এ কেলেঙ্কারিতে। এতে অর্থের পরিমাণও কম নয়, প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার।

চলতি বছর মহামারীর মধ্যেও বিশ্ব তেল উৎপাদক দেশগুলোর মধ্যে দাম নিয়ে লড়াই দেখেছে। তেলের দর নিয়ে রাশিয়া-সৌদি আরব লড়াই ও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে মার্চে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস দেখা দেয়। ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ ২ হাজার পয়েন্টের বেশি নেমে যায়। ওই মাসের শেষদিকে অপরিশোধিত ব্রেন্ট তেলের দাম ২০০২ সালের নভেম্বরের পর সবচেয়ে কম ব্যারেলপ্রতি ২৩ ডলারে নেমে আসে।

বাজার ঠিক রাখতে তেল উৎপাদক দেশগুলোর জোট ওপেক ও অন্যরা মে থেকে তেলের উৎপাদন দিনপ্রতি ৯৭ লাখ ব্যারেল কমিয়ে আনার ব্যাপারে একমত হয়। তেল উৎপাদক দেশগুলোর এ ঠোকাঠুকিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেও বেশ তৎপর দেখা গেছে। তার চাপে পড়েই সৌদি আরব তেল উৎপাদন কমাতে-বাড়াতে রাজি হয় বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।


পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিবাদের ইতিহাস নতুন নয়। ছবি: রয়টার্স

লাদাখে সংঘাত, দিল্লিতে দাঙ্গা; মিয়ানমারে নির্বাচন

বিশ্বের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত সীমান্ত ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ এ বছর ভারত ও চীনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখেছে। লাদাখের গালওয়ান সীমান্তে দুই পক্ষ পাথর, রড আর গদা নিয়ে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; এতে কেবল ভারতেরই ২০ সেনা নিহত হয়। দুই পক্ষ এরপর বেশ কয়েক দফা সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে রাজি হলেও পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়নি।

কেবল লাদাখেই নয়, সীমান্তের আরও কিছু অংশে চলতি বছর দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি সেনা সমাবেশের খবর পাওয়া যায়। পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর এ ‘অবিশ্বাস আর বৈরিতা’ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে ২০২০ সালে। ভারতে দলিতদের উপর উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন এবং মুসলিমদের উপর সামাজিক নিপীড়নের বিভিন্ন ঘটনাও বিশ্ব গণমাধ্যমে স্থান করে নিয়েছে।

তাছাড়া, বছরের শুরুর দিকে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে ঘিরে দিল্লিতে নারীদের অবস্থান ও প্রতিবাদ কর্মসূচির জেরে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল, বিজেপি নেতাদের সাম্প্রদায়িক মন্তব্য তা আরও উসকে দেয়। এক পর্যায়ে লেগে যায় দাঙ্গা, প্রাণ যায় অর্ধশতাধিক মানুষের। মুসলমান অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাংচুর হয়, অগ্নিসংযোগ করা হয় মসজিদেও।

এ বছর ভারতের লখেনৌর আদালত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায় বিজেপি নেতাদেরসহ অভিযুক্ত ৩২ জনকেই খালাস দিয়ে দেয়। মসজিদের ওই জায়গায় রামমন্দিরের নির্মাণ কাজও ২০২০ সালেই শুরু হয়েছে।

ওদিকে, জঙ্গি গোষ্ঠী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ধারাবাহিক সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও অস্থির ভারত- নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর। অঞ্চলটির রাজ্য মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার এক বছরের মাথায় গৃহবন্দি অনেক নেতা ছাড়া পেলেও উপত্যকাটিতে সহসা শান্তি আসবে এমনটা মনে হচ্ছে না। আর বছরের একেবারে শেষদিকে কৃষি সংস্কারে বিজেপি সরকারের করা তিনটি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক সংগঠনগুলোর লাগাতার আন্দোলনও ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

আফগানিস্তানে চলতি বছর তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি এবং পরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনা দেশটিতে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ অবসানের আশা জাগালেও হানাহানি বন্ধ হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের ব্যাপক সক্রিয়তাও দেখা যাচ্ছে।

মিয়ানমারে এবারের সাধারণ নির্বাচনে নোবেলজয়ী সু চির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। দেশটির রাখাইন ও কাচিনে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘাত অব্যাহত আছে। তিন বছর আগে সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযানে সীমানা টপকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরাতে আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও দেশটিকে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

শ্রীলঙ্কা আর নেপালকে ঘিরে ভারত-চীন রেষারেষির বিভিন্ন ইঙ্গিতও বছরের প্রায় পুরো সময় জুড়েই পাওয়া গেছে। দলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চমক সৃষ্টি করেছে।

মালয়েশিয়ায় ক্ষমতার টানাপোড়েন, থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ

করোনাভাইরাসের সতর্কতা উপেক্ষা করেই চলতি বছর থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান ওচার সরকারের বিরুদ্ধে এবং রাজার ক্ষমতা খর্বের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিদেশভ্রমণ শেষে অক্টোবরে রাজা ভাজিরালংকর্ণ দেশে নামার পর বিক্ষোভকারীরা তার গাড়িবহরের সামনে স্লোগান ও আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা ‘তিন আঙ্গুল স্যালুট’ দেয়।

ভাজিরালংকর্ণ গত বছর রাজসঙ্গীর মর্যাদা কেড়ে নেওয়া সিনিনাতকে এ বছর ফের আগের পদে ফেরান। মার্চে থাই রাজার একাধিক উপপত্নী ও চাকরবাকরসহ ২০ নারী নিয়ে ‘হেরেম আইসোলেশনে’ যাওয়ার খবরও বিশ্ব গণমাধ্যমের নজর কেড়েছিল।

ফেব্রুয়ারিতে নতুন জোট সরকার গঠনের আলোচনার মধ্যে হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ; কেবল তা-ই নয়, যাদের সঙ্গে জোট করে ২০১৮-র নির্বাচনে নিজের সাবেক দলকে হারিয়েছিলেন, সেই আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের সঙ্গেও ছিন্ন করেন বন্ধন।

মাহাথির হঠাৎ সরে যাওয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি আর পূরণ হয়নি। মালয়েশিয়ার রাজা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। ফলে আনোয়ারকে পাশ কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান ইয়াসিন।

এরপর ইয়াসিন সরকারকে টেনে নামাতে বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম সেপ্টেম্বরে আইনপ্রণেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকার দাবি করে মালয়েশিয়ায় নতুন সরকার গড়ার ইচ্ছার কথা জানান। তবে এখন পর্যন্ত তা সফলতার মুখ দেখেনি।

চলতি বছর মালয়েশিয়ার আদালত আলোচিত ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির এক মামলায় দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে ১২ বছরের কারাদণ্ড ও ২১ কোটি রিঙ্গিত জরিমানা করেছে।

উত্তর কোরিয়া এ বছরও তাদের আশপাশের সমুদ্রে ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রজেক্টাইল ছুড়েছে। দক্ষিণ থেকে পাঠানো বেলুনবার্তাকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের অবনতি হলে জুনে কায়েসংয়ে দুই কোরিয়ার মধ্যে থাকা লিয়াজোঁ কার্যালয়টিও ভেঙে দেয় তারা।


আজারবাইজানের বাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে কামানের গোলা ছুড়েছেন আর্মেনিয়ার একজন সৈন্য। ফাইল ছবি: রয়টার্স

নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধ

বিতর্কিত অঞ্চল নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে এ বছরই তুমুল যুদ্ধে জড়িয়েছে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া। আর্মেনীয় নৃগোষ্ঠী পরিচালিত ওই এলাকাটি আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের বলে স্বীকৃত। এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্র হিসেবে থাকা আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে ১৯৮৮ থেকেই নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে বিরোধ চলছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালেও দেশদুটির মধ্যে ৪দিনের যুদ্ধ হয়।

ককেশীয় অঞ্চলে এবারের এ সংঘাতে কয়েকশ মানুষ নিহত ও ৫০ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক বিভিন্ন শক্তিরও জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তুরস্ক প্রকাশ্যেই আজারবাইজানের পক্ষ নেয়। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় নাগোরনো-কারাবাখকে ঘিরে উত্তেজনা খানিকটা প্রশমিত হলেও বছরের একেবারে শেষে এসেও সেখানে ফের সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে।

এ বছরও লিবিয়ায় সরকারি বাহিনী ও খলিফা হাফতার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের তুমুল যুদ্ধ চলেছে। বছরের প্রথম ভাগে হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলির আশপাশে বেশ কিছু এলাকা দখলে নিতে পারলেও পরে সেগুলো তোদের হাতছাড়া হয়। তুরস্ক আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তায় বিবদমান দুই পক্ষের যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদের অভাব হয়নি। অবশ্য বছরের দ্বিতীয়ভাগে এসে দুই পক্ষ সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়।


‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’

‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না,’ আটক হওয়ার পর কাঁধে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাঁটুর চাপ সইতে না পেরে এমন কথাই বলেছিলেন অসহায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড। বছরের মাঝামাঝিতে তার করুণ মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি নির্যাতন আর কৃষ্ণাঙ্গদের উপর হওয়া ব্যাপক জাতিগত নিপীড়নের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।

মিনিয়াপোলিসে ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের পাশাপাশি বিশ্বজুড়েই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের নতুন ঢেউয়ের সূচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ এক পর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয়; সিয়াটলের এক এলাকা হয়ে ওঠে মুক্তাঞ্চল। আন্দোলন দমাতে ট্রাম্পকে মোতায়েন করতে হয় ন্যাশনাল গার্ড।

ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে দাস ব্যবসায়ীদের ভাস্কর্য উপড়ানো ও ভাঙার হিড়িক পড়ে। বিভিন্ন এলাকা থেকে সরে কলম্বাসের মূর্তি, রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি সরাতে দেওয়া হয় পিটিশন। যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনকারীরা হোয়াইট হাউসের কাছে আইকনিক অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের ঘোড়ায় চড়া মূর্তিটিও ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে।

সন্ত্রাসী হামলা চলছেই

এবছরও বিশ্বের দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলা অব্যাহত ছিল। আফ্রিকায় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো; তাদের নির্বিচারে হামলায় ঝরেছে হাজারের বেশি প্রাণও। বছরের শুরুতেই বোকো হারামের হামলায় নাইজারে মৃত্যু হয় ৮৯ সেনার। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস পাকিস্তানের কোয়েটায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে কেড়ে নেয় আরও ১৫ প্রাণ।

জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থি এক ব্যক্তি দুটি শিশা বারে বন্দুক হামলা চালিয়ে বিদেশিসহ ৯ জনকে হত্যা করে ফেব্রুয়ারিতে; নিজের অ্যাপার্টমেন্টে মাকে হত্যার পর বন্দুকধারী পরে নিজেও আত্মহ্ত্যা করে।

এপ্রিলে চাদের একটি কারাগারে সন্দেহজনক ৪৪ বোকো হারাম সদস্যের মৃতদেহ মেলে, তাদেরকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে। ওই মাসেই যুক্তরাষ্ট্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গোষ্ঠী রাশিয়ান ইমপেরিয়াল মুভমেন্টকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে ও তাদের নেতাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এটাই কট্টর শ্বেতাঙ্গ কোনো গোষ্ঠীকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা।

কানাডার নোভা স্কশায় পুলিশের পোশাক পরা এক বন্দুকধারীর হামলায় এক নারী পুলিশসহ ২২ জন নিহত হয়; পুলিশের গুলিতে পরে হামলাকারীরও মৃত্যু হয়। দলে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় মোজাম্বিকে জঙ্গিরা ৫২ জনকে হত্যা করে।

আফগানিস্তানের কাবুলে শিয়া অধ্যুষিত একটি এলাকায় মাতৃসদনে বন্দুকধারীর হামলায় দুটি সদ্যজাত শিশুসহ ২৪ জন নিহত হয়; একইদিন কুজ কুনারে একটি শেষকৃত্যে আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ যায় ৩২ জনের। অক্টোবরে কাবুলের একটি শিক্ষা কেন্দ্রে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয় অন্তত ২৪ জন।

বুরকিনা ফাসোর দিজিবোর কয়েকটি গণকবরে ১৮০টি মৃতদেহ মেলে জুলাইয়ে। জিহাদিদের সঙ্গে লড়াইরত সরকারি বাহিনীর সদস্যরাই এদের হত্যা করেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। নভেম্বরে ইথিওপিয়ায় এক হামলায় আমহারা জনগোষ্ঠীর নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধসহ ৫৪ জনের মৃত্যু হয়। ভিয়েনার বেশ কয়েকটি এলাকায় বন্দুক হামলায় ৪ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়।

চলতি বছর ইউরোপে বেশ কয়েকটি ছুরি হামলায়ও কয়েকজন নিহত হয়েছে। কানাডার কেবেকে মধ্যযুগীয় পোশাক পরিহিত একজনের ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় ২ জনের।


আর্জেন্টিনায় নির্বাসনে থাকলেও সমাজতান্ত্রিক আদিবাসী নেতা মোরালেসের ছায়া বলিভিয়াজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে আছে। ছবি: রয়টার্স

জাপানে আবের বিদায়, বলিভিয়ায় মোরালেসের প্রত্যাবর্তন

করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই বছরে জাপানে শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজনের সময়টিতেই সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারার বেদনা নিয়ে ২৮ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরে যান দীর্ঘসময় ধরে দায়িত্ব পালন করে আসা শিনজো আবে।

স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী আসার আগ পর্যন্ত তিনি দপ্তরে থাকেন। ১৬ সেপ্টম্বর ইয়োশিহিদে সুগাকে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করে জাপানের পার্লামেন্ট।

সংসদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সুগা তার পূর্বসূরি শিনজো আবের ‘অ্যাবেনোমিক্স’ নীতি ধরে রাখা এবং জাপানের অর্থনীতিকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।

ওদিকে, বলিভিয়ায় নির্বাচনে জেতার পরও ভোটে কারচুপির অভিযোগ আনা বিরোধীদের আন্দোলন আর সেনাবাহিনীর চাপে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি দেশ ছেড়ে নির্বাসনেও যেতে হয়েছে সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসকে। অনেক নাটকীয়তার পর এ বছর লাতিনের এই দেশটিতে হওয়া নির্বাচনে তার দলের প্রার্থীই বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে। যার ফলশ্রুতিতে বলিভিয়ার প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট বলিভিয়ায় বীরদর্পেই প্রত্যাবর্তন করেন।

নিউ জিল্যান্ডে গত বছর মসজিদে হামলার পর ‘ইসলামোফোবিয়া’র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ও অস্ত্র আইন কঠিন করাসহ বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে জেসিন্ডা আডার্ন এ বছরের নির্বাচনেও বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ফের প্রধানমন্ত্রী হন। অন্যদিকে, ইসরায়েলে বছরখানেকেরও বেশি সময় ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে এপ্রিলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও বেনি গান্টজ ঐক্যমতের সরকার প্রতিষ

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2