বিবিসিতে পক্ষপাতের অভিযোগে মহাপরিচালক ও বার্তাপ্রধানের পদত্যাগ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ নভেম্বর,সোমবার,২০২৫ | আপডেট: ০৪:২১ পিএম, ১০ নভেম্বর,সোমবার,২০২৫
ছবি : সংগৃহীত
দর্শকদের বিভ্রান্ত করার অভিযোগ ওঠার পর ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) মহাপরিচালক টিম ডেভি ও বার্তাপ্রধান ডেবোরা টারনেস পদত্যাগ করেছেন।
টিম ডেভি গত পাঁচ বছর ধরে বিবিসির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে সংস্থাটির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ও একের পর এক বিতর্কে তিনি ব্যাপক চাপের মুখে পড়েন।
ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ সোমবার একটি ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ মেমো প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, ‘প্যানোরামা’ প্রোগ্রামটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের দুটি অংশ সম্পাদনা করে এমনভাবে যুক্ত করেছে যাতে মনে হয় তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে হামলায় সরাসরি উস্কানি দিয়েছেন।
এ ঘটনার পর যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা আশা প্রকাশ করেছেন, পদত্যাগগুলো বিবিসিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথ খুলে দেবে। অন্যদিকে ট্রাম্প এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বিবিসির ইতিহাসে একই দিনে মহাপরিচালক ও সংবাদপ্রধানের পদত্যাগ এক নজিরবিহীন ঘটনা।
রোববার সন্ধ্যায় দেওয়া এক বিবৃতিতে ডেভি বলেন, ‘সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বিবিসিও নিখুঁত নয়। আমাদের সর্বদা উন্মুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক থাকতে হবে। বর্তমান বিতর্ক আমার পদত্যাগের একমাত্র কারণ নয়। তবে এটি অবশ্যই প্রভাব ফেলেছে। সামগ্রিকভাবে বিবিসি ভালো করছে, কিন্তু কিছু ভুলও হয়েছে—আর মহাপরিচালক হিসেবে তার দায় আমাকেই নিতে হবে।’
ডেবোরা টারনেসও রোববার রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘প্যানোরামা বিতর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে এটি বিবিসির জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। নেতৃত্বের জায়গায় দায় শেষ পর্যন্ত আমারই।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনজীবনের নেতাদের সম্পূর্ণ জবাবদিহি থাকতে হয়— এ কারণেই আমি পদ ছাড়ছি। যদিও কিছু ভুল হয়েছে, তবে সাম্প্রতিক অভিযোগ যে বিবিসি নিউজ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট—সেটি সম্পূর্ণ ভুল।’
টারনেস গত তিন বছর ধরে বিবিসির নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
দ্য টেলিগ্রাফ প্রকাশিত অভ্যন্তরীণ মেমোতে আরও বলা হয়েছে, বিবিসি আরবিক বিভাগের ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ‘পদ্ধতিগত পক্ষপাতের সমস্যা’ সমাধানে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে দেওয়া এক ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমরা ক্যাপিটল হিলে যাব এবং আমাদের সাহসী সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের উৎসাহ দেব।’
কিন্তু বিবিসির ‘প্যানোরামা’ ডকুমেন্টারিতে ভাষণটি সম্পাদনা করে এমনভাবে দেখানো হয় যে, ‘আমরা ক্যাপিটল হিলে যাব… আর আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। আমরা লড়ব। আমরা ভয়ংকরভাবে লড়ব।’
আসলে এই দুটি বাক্য ছিল ট্রাম্পের ভাষণের মধ্যে প্রায় ৫০ মিনিটের ব্যবধানে। অর্থাৎ প্রোগ্রামটির সম্পাদনায় দুটি আলাদা অংশ জুড়ে দিয়ে বক্তব্যের অর্থ বিকৃত করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই তথ্য ফাঁস হওয়ার পর বিবিসির ওপর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। টেলিগ্রাফের প্রকাশিত অভ্যন্তরীণ মেমো নিয়ে হোয়াইট হাউসও কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন বিবিসিকে ‘শতভাগ ভুয়া সংবাদমাধ্যম’ বলে আখ্যা দেয়।
রোববার বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি ও সংবাদপ্রধান ডেবোরা টারনেসের পদত্যাগের পর ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লেখেন, ‘বিবিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করছে বা বরখাস্ত হচ্ছে, কারণ তারা আমার ৬ জানুয়ারির ভাষণ বিকৃত করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আমার সেই ভাষণ ছিল একদম ভালো— নিখুঁত!’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘এরা খুবই অসৎ মানুষ, যারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। গণতন্ত্রের জন্য এটি এক ভয়ংকর বিষয়!’
বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি ও সংবাদপ্রধান ডেবোরা টারনেসের পদত্যাগের ঘোষণা আসে এমন এক সময়, যখন সোমবার পার্লামেন্টের এক কমিটির সামনে বিবিসির চেয়ারম্যান সামির শাহ একটি বিবৃতি দিতে যাচ্ছেন—যেখানে তিনি ট্রাম্পের ভাষণ সম্পাদনার ঘটনাটির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
রোববার পদত্যাগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সামির শাহ বলেন, ‘এটি বিবিসির জন্য এক দুঃখের দিন।’
তিনি জানান, মহাপরিচালক হিসেবে টিম ডেভি তার পুরো মেয়াদে বোর্ড ও চেয়ারম্যানের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে তার ওপর চলমান চাপের বিষয়টি বুঝতে পারছি। এই কারণেই তিনি আজকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বোর্ড তার সিদ্ধান্ত ও কারণকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করছে।’
ফাঁস হওয়া মেমোটি লিখেছিলেন মাইকেল প্রেসকট, যিনি সম্প্রতি পর্যন্ত বিবিসির সম্পাদকীয় মানদণ্ড বিষয়ক কমিটির একজন স্বাধীন উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি জুন মাসে পদ ছাড়েন।
প্রেসকট তার মেমোতে শুধু ‘প্যানোরামা’ বিষয়েই নয়, ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক প্রতিবেদন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিবিসির ট্রান্স কভারেজ কার্যত ‘নির্বাচিতভাবে সেন্সর করা’ হচ্ছে—যেখানে কিছু বিশেষায়িত এলজিবিটিকিউ সাংবাদিক প্রো-ট্রান্স দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিচ্ছেন।
তার মেমোতে আরও বলা হয়, ‘যখন গুরুতর সমস্যা সামনে আসে, তখন বিবিসির ব্যবস্থাপনা যেভাবে নীরব থাকে, তা দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়ি।’
বিতর্কিত ‘প্যানোরামা’ প্রতিবেদনের ঘটনায় মহাপরিচালক ও সংবাদপ্রধানের পদত্যাগের পরও বিবিসি নতুন সমালোচনার মুখে পড়েছে। একাধিক সাবেক কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক সংস্থাটির প্রতিক্রিয়া প্রদানের ধীরগতি ও সম্পাদকীয় ব্যর্থতাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন।
বিবিসির টেলিভিশন নিউজ বিভাগের সাবেক প্রধান রজার মোসি বলেন, ‘বিবিসি সর্বশেষ অভিযোগের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাতে খুবই ধীর ছিল।’ তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ট্রাম্পের ভাষণ সম্পাদনার বিষয়টি কোনোভাবেই ন্যায্যতার মধ্যে পড়ে না।’
তবে তিনি যোগ করেন, ‘মেমোতে ট্রান্স ইস্যু সংক্রান্ত যে ভাষাগত উদ্বেগ তোলা হয়েছে, সেটি এমন এক ক্ষেত্র যেখানে বিবিসিকে সময় সময় নিজেদের সম্পাদকীয় নীতি পুনর্গঠন করতে হয়।’
অন্যদিকে ‘চ্যানেল ৪’-এর সাবেক সংবাদপ্রধান ডরোথি বার্ন বিবিসির সমালোচনা করে বলেন, ‘তারা শুধু সম্পাদনায় মৌলিক ভুলই করেনি, বরং ক্ষমা চাইতেও অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ সময় নিয়েছে। এটি অত্যন্ত অদক্ষ ব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত।’
২০ বছর ধরে বিবিসিতে কর্মরত টিম ডেভি তার পদত্যাগের বিবৃতিতে বলেন, ‘বিবিসির সাংবাদিকতা ও কনটেন্টের মান এখনো আন্তর্জাতিকভাবে সোনার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠান মূলত সহানুভূতিশীল, সহনশীল এবং কৌতূহলী একটি সংস্থা।’
তিনি আরও জানান, আসন্ন মাসগুলোতে তার পদত্যাগের পর একজন নতুন মহাপরিচালকের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর ‘শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে’ সম্পন্ন হবে। এতে নতুন মহাপরিচালক আগামী রয়্যাল চার্টার নিয়ে আলোচনায় ইতিবাচকভাবে ভূমিকা রাখতে পারবেন।
উল্লেখ্য, রয়্যাল চার্টারই নির্ধারণ করে বিবিসির তহবিল, কাঠামো ও নিয়ন্ত্রক দায়িত্ব। বর্তমান চার্টারের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালের শেষে, তার আগেই নতুন চার্টার নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে।
ব্রিটিশ সংস্কৃতিমন্ত্রী লিসা নন্দী টিম ডেভিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘তিনি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের এক সময় বিবিসিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিবিসি আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এখন, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি, বিশ্বস্ত সংবাদ ও উচ্চমানের প্রোগ্রামিং আমাদের গণতন্ত্র, সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানের জন্য অপরিহার্য।’
আরও পড়ুন
এই বিভাগের আরো খবর
প্রধান উপদেষ্টার বিবৃতির শব্দ চয়ন নিয়ে ‘সতর্ক থাকার’ আহ্বান: রাজনাথ সিং
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ভারতের তিনটি নতুন সেনা ঘাঁটি স্থাপন
নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র হলেন জোহরান মামদানি
আফগানিস্তানে মধ্যরাতে শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহত ৭, আহত ১৫০





