avertisements 2

কেউ শুনছে না কারও কথা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৮ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:২৯ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ে। আর বাজারে তৈরি হয় অস্থিরতা। পিয়াজ, আলু, ডিমের দাম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে বিরাজ করছে অস্বস্তিকর অবস্থা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেঁধে দেয়া হয়েছে দাম। কিন্তু সরকারিভাবে দাম বেঁধে দেয়ার দুইদিন পরও বাজারে ওই দামে পণ্য মিলছে না। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন পাইকারিতে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ কারণে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন মজুতদারকে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানও পরিচালনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে কেউ কারও কথা শুনছে না। ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মজুতদারের ইচ্ছামতো চলছে বাজার। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সক্রিয় রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কিছুতেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। 

সরজমিন গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা য়ায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে আলু, ডিম। উল্টো দুই দিনের ব্যবধানে  কোথাও কোথাও দাম বাড়ার কথাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।  রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি আড়ত কাওরান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কেজিপ্রতি আলু পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা ও  পিয়াজ ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। একই বাজারে খুচরা পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ও পিয়াজ ৮৮ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে। মায়ের দোয়া বাণিজ্যালয়, মাতৃভাণ্ডার, আরাফাত ট্রেডার্স, বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়, বরিশাল বাণিজ্যালয়সহ বিভিন্ন আড়ত মালিকরা জানান, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় হাট থেকে আলু কিনে ঢাকায় এনে বিক্রি করা হয়। আলুর দামের সঙ্গে যোগ হয় নানা খরচ। এর মধ্যে পরিবহন খরচ, দোকান ভাড়া, লেবার খরচ ইত্যাদি যোগ করে দাম নির্ধারণ করতে হয়। 

তারা জানান, অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে কম দামে আলু কিনে আগেই কোল্ড স্টোরেজে রেখে দিয়েছেন। সেই আলু এখন ধীরে ধীরে বাজারে ছাড়ছেন। বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান সীমিত দেখিয়ে কয়েকগুণ মুনাফা লুটছেন তারা। টাকা দিলেও মাল দিচ্ছেন না। 

পাবনা থেকে কাওরান বাজার আড়তে পিয়াজ বিক্রি করতে আসা মিরাজ নামে এক বেপারি বলেন, ঢাকায় মূলত দেশি পিয়াজ আসে পাবনা আর ফরিদপুর থেকে। এ ছাড়াও রাজশাহী ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অল্প কিছু আসে। তিনি বলেন, বর্তমানে ভালোমানের দেশি পিয়াজ ঢাকা পর্যন্ত আনতে কেজিপ্রতি ৭৪ টাকা খরচ পরে যাচ্ছে। এরপর আড়ত ভাড়া, লেবার কস্ট, নিজেদের থাকা-খাওয়া সহ আরও বেশকিছু খরচ রয়েছে। এসব মিলিয়ে ভালোমানের পিয়াজ আড়তেই কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার উপরে। তবে নিম্নমানের পিয়াজ কিছুটা কম দামে পাওয়া যায়। তাও ৭৬ টাকার নিচে নয়। তাহলে কীভাবে সরকারের বেঁধে দেয়া দাম ৬৫ টাকায় বিক্রি করবো! এত লোকসান দিয়ে তো আর ব্যবসা করা যায় না। 

মোহম্মদপুর-ধানমণ্ডি এলাকার পাইকারি কাঁচামালের আড়ত সাদেক খান মার্কেটে গিয়ে দেখা যায় আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে পিয়াজ, আলু সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। মার্কেটের মেসার্স পাবনা ভাণ্ডার, মেসার্স রাজবাড়ী ট্রেডার্স, মেসার্স মালেক এন্টারপ্রাইজ সহ বেশ কিছু আড়তের মালিক জানান, মৌসুমের শুরুতে তারা ৫০ কেজির প্রতিবস্তা আলু ৭শ থেকে ৭শ ৫০ টাকায় কিনেছিলেন। সেসব আলুর বস্তা এখন কিনতে হচ্ছে ২৬শ থেকে ২৭শ টাকায়। সেই হিসাবে, কেউ যদি এক হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেন তবে বর্তমান বাজারে বিক্রিতে তার লাভের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪ লাখ টাকায়। মেসার্স পাবনা ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, আমাদের বেশির ভাগ কৃষকই ধারদেনা করে ফসল ফলায়। তাই ধার মেটানোর আশায় তাদের উৎপাদিত আলুর বড় অংশ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে  দেন। আর সেই আলু হিমাগারে মজুত করে মুনাফা লুটছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। রহমান নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, সিন্ডিকেটের পাশাপাশি দাম বৃদ্ধির আরেক কারণ হলো হাত বদল। হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণে রেখেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেনাবেচা চলতে থাকে। এতে প্রতি হাত বদলেই দাম বেড়ে যায়। আর আমাদের মতো আড়তদাররা এই সিন্ডিকেটের কাছ থেকে বেশি দামে পণ্য কেনায় বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তাই বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি করা সম্ভব হয় নয়। 

ধানমণ্ডির সবচেয়ে বড় খুচরা বাজার রায়ের বাজারে গিয়েও দেখা যায়, আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি আর প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা দরে। ডিম ১৫০ টাকা ডজন। শোহানুর নামে এক দোকানি বলেন, আমরা বেশি দামে কিনলে তো দাম বাড়িয়েই বিক্রি করতে হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে এসে তো গচ্চা দেবো না।  লিয়াকত আলী নামের এক ক্রেতা বলেন, শুধু দাম বেঁধে দিলেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। হাতে গোনা কয়েক জায়গায় অভিযান চালালেই এই দাম কর্যকর হবে না।  ফার্মগেট তেজতুরি বাজারে সবজি কিনতে আসা দুলাল আহমেদ বলেন, এর আগেও সয়াবিন তেল ও চিনির দাম বেঁধে দেয়া হয়েছিল। আজ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। এখন আবার পিয়াজ ৬৫ টাকা, আলু ৩৫/৩৬ টাকা ও ডিম ১২ পিস দাম নির্ধারণ হয়েছে। যার তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, বাজারের প্রতিটি জিনিসের দামই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এভাবে দুই একটা পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। সবার আগে বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। 

শনিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তাহমিনা বেগম ও ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাগফুর রহমানকে আলু, পিয়াজ ও ডিম সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তদারকি করতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল কাঁচাবাজারে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেছে। এর আগে ওই টিম রাজধানীর নিউমার্কেটের বনলতা কাঁচাবাজারেও অভিযান পরিচালনা করে। এ ছাড়া বাড্ডা-রামপুরা-মহাখালী এলাকায় ও আরেকটি ডেমরা-স্টাফ কোয়ার্টার-কোণাপাড়া এলাকায়ও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানের সময় চাপে পড়ে দোকানি বেঁধে দেয়া দামে পণ্য বিক্রি করলেও কর্মকর্তারা যাওয়ার পরই তারা আর নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করছেন না।  
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী ভোক্তাপর্যায়ে আলুর দাম বাস্তবায়ন করতে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ঢাকা সহ সারা দেশে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে ।

তিনি বলেন,  এ বছর যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে এতে দেশে আলুর কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে। সফিকুজ্জামান বলেন, আলুর বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতাকে পাকা রসিদ ব্যবহার করতে হবে। পাকা রসিদ না থাকলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শনিবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ পরিদর্শন করেন ডিজি। এ সময় মুক্তারপুরে রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ থেকে ১০ হাজার বস্তা আলু জব্দ করেন এবং পাকা রসিদ ছাড়া মোবাইলে দাম নির্ধারণ করে আলু বিক্রি করার অভিযোগে রসরাজ বাবু নামের ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আলু ব্যবসায়ী রসরাজের কথায় অসঙ্গতি থাকায় এবং পাকা রসিদ ছাড়া আলু বিক্রি করায় হিমাগারে তার সংরক্ষিত আলু হেফাজতে নিয়ে ২৭ টাকা মূল্যে সেই আলু বিক্রি করে দাম বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তিনি স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেন।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2