avertisements 2

চিংড়ি ঘেরে ধুন্ধুমার চাঁদাবাজি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ জুন,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:২৩ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২৪

Text

পরিবেশ অনুকূলে থাকায় কক্সবাজারের চকরিয়ায় লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে এবারের মৌসুমে। এরই মধ্যে মাঠ থেকে লবণ আহরণের কাজও শেষ হয়েছে। এখন সেসব মাঠসহ এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকায় চলছে চিংড়ি চাষের জন্য ঘের তৈরির কাজ। লবণের মতো চকরিয়াসহ আশপাশের এলাকাও চিংড়ি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। পরিবেশসহ সবকিছু ঠিক থাকলে লবণের মতো চিংড়ির উৎপাদনও এবার ভালো হবে বলে আশা করছেন চিংড়ি চাষিরা। তবে প্রতিবছর এই এলাকায় ঘের মালিক চিংড়ি চাষিদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে এলাকাভিত্তিক বেশ কিছু চাঁদাবাজ গ্রুপ। পাঁচ হাজার কোটি টাকার এ বাজারে চলতি মৌসুমেও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে এসব চাঁদাবাজ। এলাকাভিত্তিক কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় এই চাঁদাবাজি চলছে। তাদের অনেকেই আবার চিহ্নিত ডাকাত।

চকরিয়ায় চিংড়ি মৌসুমে কীভাবে এবং কী পরিমাণ চাঁদাবাজি হয়, এ নিয়ে সরেজমিন বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। ঘের মালিক, চিংড়ি চাষি, মৎস্য কর্মকর্তা ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়ায় এবারের মৌসুমে ১৮ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এক হেক্টর সমান হচ্ছে ২ দশমিক ৪৭ একর। আর ১৮ হাজার ৪৩৩ হেক্টর হয় ৪৫ হাজার ৫৩০ একর। চিংড়ি মৌসুম আট মাসের। প্রতি মাসে দুই জোঁ হিসাব করে থাকেন চিংড়ি চাষিরা। আট মাসে জোঁর সংখ্যা ১৬। প্রতিটি জোঁতে প্রতি একর ঘের থেকে চাঁদা আদায় করা হয় ৫০০ টাকা। কোনো কোনো এলাকায় হাজার টাকা হারেও চাঁদা আদায় করা হয়। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাঁদা দিতে না হলেও অন্তত ৮০ ভাগ ঘেরের মালিককে দুর্বৃত্তদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা আদায়ের হার ৫০০ টাকা হলেও হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি মৌসুমে দুর্বৃত্তদের পকেটে যাচ্ছে ২৯ থেকে ৩০ কোটি টাকা।

এদিকে, চকরিয়ায় চিংড়ি ঘেরে চাঁদাবাজির বিষয়টি এলাকায় এক প্রকার ‘ওপেন সিক্রেট’। মৌসুমের পর মৌসুম এভাবে চাঁদা দিতে হচ্ছে। কিন্তু ভয়ে মুখ খোলেন না চিংড়ি চাষিরা। মুখ খুললে তাঁদের খেসারত দিতে হয়। চাঁদাবাজরা ডাকাতি করে নিয়ে যায় ঘেরের মাছ ও মাছ চাষের নানা উপকরণ।

বিভিন্ন পর্যায়ে খবর নিয়ে জানা গেছে, চকরিয়ার চিংড়ি জোন এলাকায় চাঁদাবাজিতে গ্রুপভিত্তিক নেতৃত্ব দিচ্ছে বহলতলী, চরণদ্বীপ, রামপুর আংশিক চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগরঘোনা এলাকার জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রহিম, জমির উদ্দিন ও আবদুল মান্নান। তাদের অধীনে রয়েছে আরও ২৫ থেকে ৩০ জন সদস্য। উপজেলার বদরখালী ও রামপুর আংশিক অংশে চাঁদাবাজদের নেতৃত্ব দিচ্ছে জালাল আহমদ, রমিজ উদ্দিন, আবদুর রহিম ও পাইক্যা। তাদের অধীনে রয়েছে ১৫ থেকে ২০ জনের চাঁদাবাজ। অন্যদিকে রামপুর, পশ্চিম বড় ভেওলা, দরবেশকাটা অংশে চিংড়ি ঘের দখল-বেদখলসহ চাঁদাবাজিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাদল ও লেদু নামের দুই দুর্বৃত্ত। তারা দু’জনই সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবী হোসেনের সৎভাই। তাদের মধ্যে লেদু ২০২২ সালের ১৬ মার্চ র‍্যাবের হাতে ছয়টি দেশীয় বন্দুকসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল। তাদের অধীনে রয়েছে ২০ থেকে ২৫ জন সন্ত্রাসী। এই দলটির বিরুদ্ধে রাতে চিংড়ি ঘেরে চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ চকরিয়া ও মহেশখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে ডাকাতির অভিযোগও রয়েছে।

দুর্বৃত্ত-সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকরিয়া থানার ওসি চন্দন কুমার চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, এসব দুর্বৃত্ত-সন্ত্রাসীর অনেকের বিরুদ্ধে ডাকাতি, খুনসহ একাধিক মামলা রয়েছে। আত্মগোপন করে থাকায় তাদের আটক করা যাচ্ছে না। চকরিয়ার ডুমখালী এলাকা থেকে ডজনখানেক মামলার ফেরারি আসামি চাঁদাবাজ কলিমুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ওসি জানালেন, ঘের থেকে চিংড়ি মাছ লুটপাট কিংবা ডাকাতি হয়ে গেলেও ডাকাত-চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে রাজি হন না কেউ। এ ছাড়া চাঁদাবাজির ঘটনা জানলেও পুলিশ ঘের এলাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে চাঁদাবাজরা নৌপথে পালিয়ে যায়। চিংড়ি ঘের এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় অপরাধীরা অপরাধ করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। এরপরও যাতে চিংড়ি ঘেরে চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায়, সে জন্য ঘের এলাকার চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব এলাকার একাধিক ঘের মালিক ও চিংড়ি চাষি বলেন, চিংড়ি চাষে বড় একটি সমস্যা হচ্ছে চাঁদাবাজি। এটি বন্ধ হলে আরও অনেকেই চাষে আগ্রহী হবেন। বাড়বে চিংড়ির উৎপাদন, কমবে দামও। চাঁদাবাজি বন্ধে যৌথ বাহিনী কর্তৃক অভিযানের জোর দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

চকরিয়া মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, চকরিয়া সুন্দরবনের বহলতলী রিংভং, পালাকাটা চরণদ্বীপ, রামপুর, বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা, দরবেশকাটা, কোনাখালীসহ আরও কয়েকটি এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকায় চিংড়ি চাষ হয়। বাগদা, গলদা ও সাদা চিংড়ি ছাড়াও চাষ হয় আরও কয়েক জাতের চিংড়ি। এসব এলাকার প্রায় ১৮ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে প্রতিবছর চিংড়ি চাষ হয়ে আসছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৪ হেক্টর; ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৫ হাজার ৫৯৯ হেক্টর। এ পরিমাণ জমিতে একসময় প্রতি হেক্টরে ৬০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো। তবে নানা কারণে বর্তমানে চিংড়ি উৎপাদন অনেকটা  হ্রাস পেয়েছে। এখন প্রতি হেক্টর জমিতে সর্বোচ্চ ৩৮০ থেকে ৪০০ কেজি উৎপাদন হচ্ছে না। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪০০ কেজি করে চিংড়ি উৎপাদন হলে ১৮ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে ৭ হাজার ৪৪৮ টন চিংড়ি উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতি কেজি চিংড়ির গড় মূল্য (ছোট-বড়) ৭০০ টাকা হিসাবে বিক্রি করলে যার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৫ হাজার ২১ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির লবণাক্ত পানির মাছ তো রয়েছে। এসব মাছের বাজারমূল্য কমবেশি আড়াই কোটি টাকা।

সদ্য অবসরে যাওয়া জেলার মৎস্য কর্মকর্তা চকরিয়া উপজেলার বাসিন্দা ছরওয়ার জাহাঙ্গীর বলেন, আশির দশকে যখন চকরিয়ায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়, তখন প্রতি হেক্টর জমিতে ৬০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো। নির্বিচারে প্যারাবন ধ্বংস ও তামাক চাষের কারণে চিংড়ির উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। তামাক চাষ করার সময় পোকা ও পোকার ডিম মেরে ফেলতে প্রয়োগ করা বিষ বর্ষাকালে বৃষ্টির সঙ্গে চিংড়ি ঘেরে গিয়ে মেশে। তাতে পানি বিষাক্ত হয়ে চিংড়ি মারা যায়। এটা রোধ করা না গেলে একসময় উপকূলীয় এলাকার চিংড়ি উৎপাদন আরও হ্রাস পাবে।

চকরিয়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তাজিন ফরহান বলেন, চকরিয়া হচ্ছে লবণ ও চিংড়ি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত এলাকা। কিন্তু নানা কারণে চিংড়ি উৎপাদন কমে আসছে। তবে এবার চাষিদের মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

চকরিয়া উপজেলার চিংড়ি চাষি কক্সবাজার জেলা পরিষদের সদস্য আবু তৈয়ব সমকালকে বলেন, চকরিয়া উপকূলের চিংড়ি চাষের আগের সেই সুদিন নেই বললেই চলে। চাষিরা পুঁজি বিনিয়োগ করে, নানা বিপত্তি উপেক্ষা করে পরিশ্রমের মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। একই উপজেলার বদরখালী এলাকার চিংড়ি চাষি নুরুন্নবী বলেন, উৎপাদন কমে আসায় চিংড়ি রপ্তানিও কমে এসেছে। বর্তমানে বড় সাইজের বাগদা ও গলদা চিংড়ি রপ্তানি অনেকটাই বন্ধ।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2