avertisements 2

ইসি কি নাচের পুতুল

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ নভেম্বর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:১০ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

‘বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে এমন কোনো কথা সংবিধানে লেখা নেই’ (আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান)। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল শনিবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে আলোচনার পর তিনি এই মন্তব্য করেন। প্রশ্ন হচ্ছে সংবিধানে কী নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার কথা লেখা আছে? নাকি ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা লেখা আছে? সংবিধানের জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য সংবিধান? দেশি-বিদেশি চাপের মুখেও সরকার যখন ২০১৪ সালের মতো আরেকটি পাতানো নির্বাচনের মনোস্থির করেছে তখন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন কি আগের সিইসি কাজী রকিবু্িদ্দন আহমদ ও কে এম নুরুল হুদার পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তার দল নির্বাচন বর্জন করলেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল।’

হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। গতকাল আয়োজিত নির্বাচন কমিশনের এই সংলাপে ৪৪টি নিবন্ধিত দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এসব দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৮ দলই ইসির সংলাপ বর্জন করেছে। বিএনপিসহ সংলাপ বর্জন করা দলগুলোর দাবি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে, জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এই সরকার প্রশাসন, পুশিলকে ব্যবহার করে পাতানো নির্বাচন করেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। আন্দোলনরত দলগুলোর এমন ঘোষণার মধ্যেই সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘ পর্যন্ত পাতানো নির্বাচনের চিন্তা পরিহার করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনে দাবি জানিয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে এমন বার্তাও দিয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন কার স্বার্থে পাতানো নির্বাচনের পথে হাঁটছে সে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কারণ দেশের রাজনৈতিক স্থিতি ও অর্থনীতির গতিশীলতার স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য মনে করছেন বিশিষ্টজন ও অর্থনীতিবিদরা।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ চায় ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। বিএনপির নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবির আন্দোলনে শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ মানুষ সমর্থন দিচ্ছে। সভা-সমাবেশগুলোতে তার প্রমাণ মেলে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও প্রভাবশালী দেশগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সংকট সুরাহার প্রকাশ্যে পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা পাতানো নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে। গত ২ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এই সন্ত্রাসী, জঙ্গি, এ অমানুষগুলো, এদের সঙ্গে কারা থাকে, আর তাদের সঙ্গে বসা? এই জানোয়ারদের সঙ্গে বসার কথা কারা বলে? আমার কথা হচ্ছে জানোয়ারদেরও একটা ধর্ম আছে। ওদের সে ধর্মও নাই। ওদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ববোধ নেই। ওরা চুরি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ছাড়া কিছুই জানে না। এই জানোয়ারদের সঙ্গে সংলাপ নয়।’ একই দিন সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি এরই মধ্যে নিজেদের সন্ত্রাসী দল হিসেবে প্রমাণ করেছে। এমন একটি সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমিও বলছি।’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এমন বক্তব্যের পরও নির্বাচন কমিশন সংলাপের আয়োজন করেছে। বিএনপির মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা কারাগারে বন্দি জেনেও সংলাপের আমন্ত্রণপত্র দলটির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গেটেই চেয়ারে এবং চেয়ারপাসনের কার্যালয়ে দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছে পথচারীদের সাক্ষী রেখে। ইসির এই মস্করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনদের মধ্যে বিতর্কের ঝড় উঠেছে।

অবরোধে দেশের রাজপথ টালমাটাল অবস্থা। ঘরে বসে থেকে মানুষ অবরোধকে সমর্থন জানাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা প্রতিদিন বিএনপির মুণ্ডুপাত করছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে নেতারা বিএনপিকে নিয়েই বেশি কথা বলছেন। একটি সমাবেশ ৪ ঘণ্টা স্থায়ী হলে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা বিএনপির নাম নিয়ে দলটির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ফলে বিএনপির প্রচারণায় তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য, বিএনপির প্রচারণায় আওয়ামী লীগই যথেষ্ট।

কাজী হাবিবুল আউয়াল গত সপ্তাহে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নেই। তারপর তিনি সাবেক দুই সিইসি কাজী রকিবু্িদ্দন আহমদ ও কে এম নুরুল হুদার মতোই পাতানো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনের সময় ৩শ’ ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জানাতে আগামী ৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সময় নিয়েছেন। গতকাল আওয়ামী লীগসহ নিবন্ধিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের আলোচনার পর সিইসির একান্ত সচিব রিয়াজউদ্দীন জানিয়েছেন, পয়লা নভেম্বর নির্বাচনকালীন ৯০ দিন ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। তিনি বলেছেন, নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের ক্ষণ গণনা শুরুর পর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সিইসির নেতৃত্বে ইসির সদস্যরা।

দেশে এখন চলছে রাজনৈতিক সংঘাত। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো ২০১৩ সালের মতোই হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে ফিরে গিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। দলটির শীর্ষস্থানীয় বহু নেতা গ্রেফতার হলেও অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বক্তব্যে নতুন কর্মসূচির কথা জানাচ্ছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই দাবির বিষয়টি পূরণ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে। তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো ভোটের আয়োজন করা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ৩০ জানুয়ারি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী এর আগে ৯০ দিনের মধ্যে ভোট হতে হবে। সেই হিসাবে গত ১ নভেম্বর নির্বাচনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে গেছে। ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা আছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণের ভোটের অধিকার হারিয়ে গেছে। ওই দুই নির্বাচনের যারা ইসির দায়িত্বে ছিলেন তারা ক্ষমতাসীনদের ‘নাচের পুতুল’ হয়ে বিতর্কিত নির্বাচন করে এখন আফসোস করছেন। তাদের মতোই বর্র্তমান সিইসি ‘নাচের পুতুল’ হয়ে সরকারের তাঁবেদারি করতে নির্বাচন করার জন্য উঠেপড়ে নেমেছেন?

হঠাৎ করে রাজনৈকি দলগুলোকে সংলাপের জন্য ডাকা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগত এই নেতা সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের উদ্দেশে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আপনার চাকরি করে না যে, আপনি চাইলেই তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠাবেন। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাদের ভদ্রভাবে বলতে হবে কখন তারা সময় পাবেন। তখন তাদের সঙ্গে আলোচনা করুন।’

আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি কয়েক বছর আগে জাতীয় সংসদ নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে ‘নাচের পুতুল’ হিসেবে অবিহিত করেছিল। এ নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ হলেও জাতীয় পার্টির নেতারা বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি পরিচিতি ক্রাইসিসে ভুগছে। দেশ-বিদেশের কেউ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে দাম দেয় না; আওয়ামী লীগের বি-টিম বলে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে দেশে যখন রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল তখন নির্বাচন কমিশন সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা কী জাতীয় পার্টির মতোই কারো ‘নাচের পুতুল’ হয়ে ভোটের আয়োজন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2