avertisements 2

পাহাড়ে শান্তি কত দূর

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:০৫ পিএম, ৩ মে,শুক্রবার,২০২৪

Text

সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) শান্তিচুক্তির দুই যুগ আজ। চুক্তির দুই যুগে দুইপক্ষেরই ধারণা, শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে। নতুন করে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। শান্তিচুক্তির সময় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ছিল জেএসএস। এখন সেখানে পাঁচটি সংগঠন আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত। তাদের কোন্দলে পাহাড় মাঝে মাঝেই অশান্ত হয়ে ওঠে।

চুক্তির দৃশ্যমান সুফল হলো, গত দুই যুগে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সড়ক যোগাযোগসহ ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সংগঠন জেএসএসসহ আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও মূল ভূখণ্ড থেকে নানিয়ারচর পর্যন্ত পাহাড়ি জনপদের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সরকারদলীয় পাহাড়ি নেতারা বরাবরই বলছেন, চুক্তির কারণে পার্বত্য তিন জেলায় প্রত্যাশার চেয়েও বেশি উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অন্তর্দ¦ন্দ্ব ও হানাহানি তাদের শঙ্কিত করে রাখে।

রাঙামাটি স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যান অংশুইপ্রু চৌধুরী বলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বসে টেনশন করলে তো নিজেকে সুখী বলতে পারি না। চারটি দল আছে। সবাই আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। জড়িয়ে পড়েছে চাঁদাবাজিতে। সাধারণ মানুষের মধ্যে হয়তো এ নিয়ে খুব মাথাব্যথা নেই, কিন্তু রাজনীতিতে তো একটা সংকট তৈরি হয়েছে। পাহাড়ে পূর্ণ শান্তি বজায় থাকতে হলে আঞ্চলিক দলগুলোকে সমঝোতায় আসতে হবে।

জেএসএসের প্রচার সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা এ প্রসঙ্গে আমাদের সময়কে বলেন, চাঁদাবাজিসহ যা কিছু হচ্ছে তা হলো চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার উপসর্গমাত্র। পাহাড়ে উন্নয়ন হোক তা আমরা চাই। তবে সবার আগে শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হতে হবে। নইলে পাহাড়ে শান্তি ফিরবে না।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওইদিন খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা প্রধানমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র জমা দেন। সে সঙ্গে তার অনুসারীরা অস্ত্রসমর্পণ করে

স্বাভাবিক জীবনে ফিরেন। চুক্তি সম্পাদনের দিন পর্যন্ত জেএসএস ছিল পাহাড়িদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু চুক্তির দিনই খাগড়াছড়ি মাঠে ব্যানার তুলে ধরে পার্বত্য শান্তি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে জন্ম হয় ইউপিডিএফের। যেটির নেতৃত্ব দেন সন্তু লারমারই একসময়ের শিষ্য প্রসিত বিকাশ খীসা। সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। পরে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়।

২০০৮ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালে জেএসএস ভেঙে জেএসএস সংস্কার নামে আরেকটি আঞ্চলিক সংগঠনের জন্ম হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলে ও সুধা সিন্ধু খীসা। শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘাত। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরও একটি সংগঠন হয়। এতদিন জেএসএস ও ইউপিডিএফের সংঘাতকে পাহাড়িরা ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ আখ্যা দেয়। তবে চার সংগঠন সৃষ্টির পর রাতারাতি এই দুই সংগঠনের মধ্যে ঐক্য হয়। এর পর পাহাড়ে সংঘাত আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ২০১৮ সালের ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা খুন হন। পরদিন ৪ মে তার দাহক্রিয়ায় যোগ দিতে খাগড়াছড়ি থেকে নানিয়ারচর যাওয়ার পথে খুন হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ৬ জন।

এ ছাড়া গত বছরের ৭ জুলাই বান্দরবান জেলার সদর উপজেলার বাগমারা বাজারপাড়া গ্রামে ব্রাশফায়ারে জেএসএস সংস্কারপন্থি দলের ছয়জনকে খুন করা হয়।

পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর সরকারি কর্মকর্তারা বড় ধরনের হামলার শিকার হননি। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন শেষে বাঘাইছড়ির সাজেকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারসহ ৬ জন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন ১৬ জন।

জেএসএসসহ পাহাড়ি সংগঠনের হত্যা ও হুমকির মুখে ২০১৭ সালে ৩৫৫ জন পাহাড়ি আওয়ামী লীগ নেতা দলত্যাগ করেন। তার পরও আওয়ামী লীগ নেতা খুন বন্ধ হয়নি। ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে খুন করে। একই বছরের ১৯ মে রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ক্য হ্লা চিং মারমাকে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। একইদিন বান্দরবান রাবার বাগান-৮ এলাকায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কে চিং থোয়াই মারমা খুন হন। ২২ মে বান্দরবান পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর চ থোয়াই মং মারমা অপহৃত হন। ২৫ মে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের রাজভিলার জামছড়িতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি বাচানু মারমাকে খুন করে জেএসএস অস্ত্রধারীরা। চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর চিতমরম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাতি নেথোয়াই মারমাকে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। বান্দরবানে মগ পার্টি নামের আরও একটি সংগঠন সৃষ্টি হয়, যাদের কার্যক্রম চাঁদাবাজি আর খুন খারাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, ২৪ বছরে শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াটা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই কষ্টকর-যন্ত্রণাকর। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী দুইপক্ষের ভিতরে যে দূরত্ব-সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে তা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সপ্তাহখানেকের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠক হবে। আমরা চাই অবাস্তবায়িত ধারাগুলো যেন বাস্তবায়িত হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে। অন্যগুলো বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৪তম বর্ষ আজ। নানা আয়োজনে দিনটি উদযাপন করছে জেলা পরিষদ জেলা প্রশাসনসহ সরকারি দলের নেতারা।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2