avertisements 2

'আইসিইউতে আছিস, নাম বললে মর্গে থাকবি'

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ ফেব্রুয়ারী, বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:০৪ পিএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

'রুমে নিয়েই আমাকে স্টাম্প, লাঠি, পাইপ দিয়ে পিটানো শুরু করে। আমি কোথাও ক্লাস নেই কিনা জিজ্ঞেস করে। উত্তরে না বলার পর আমার চোখ বেঁধে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি দিতে থাকে। এরপর তারা আমাকে চেয়ার থেকে ফেলে দিয়ে একের পর এক লাথি মারতে থাকে। শব্দ যাতে না হয়, সে জন্য মুখের ওপর ঢালতে থাকে পানি। মার খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আবার দুই মিনিটের জন্য চেয়ারে বসায়। তারপর আবার শুরু করে নির্যাতন। এ ঘটনা কাউকে বললে জানে মেরে ফেলবে বলে শাসিয়ে দেওয়া হয়। আইসিইউতে গিয়েও তারা বলে, এখন তো আইসিইউতে আছিস; নাম বললে মর্গে থাকবি।' নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা এভাবেই দিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল। নির্যাতনের শিকার হয়ে আইসিইউতে থাকা আরেক ছাত্র সাকিব হোসেন লেখেন, 'আমার মুখ বেঁধে ফেলে ওরা। শব্দ বের যাতে না হয়, সে জন্য মুখে পানি ঢালতে থাকে। এক পর্যায়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে পানি ঢালা বন্ধ করে। শুরু করে মারধর।' চমেক অধ্যক্ষের কাছে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে এভাবেই ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সহপাঠীর হাতে গত বুধবার রাতে নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন দুই শিক্ষার্থী। এসব চিঠির কপি সমকালের কাছেও আছে।

জানতে চাইলে কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার সমকালকে বলেন, 'ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। মঙ্গলবার সংশ্নিষ্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠকও করেছি। ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। রিপোর্ট পেলে দোষীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' অধ্যক্ষ এমনটি বললেও অভিযুক্তরা এখনও মহড়া দিচ্ছে ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে। এদিকে সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া ও নিরাপত্তার আকুতি জানিয়েছেন ওয়াকিলের বাবা মো. ফরহাদ হোসেন, মা শিউলী বেগম এবং সাকিবের বাবা আবদুল কাদের, মা রেনু আরা এবং মামা বদিউল আলম। নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে তাঁরাও চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।

চিঠিতে যা লিখেছেন ওয়াকিল ও তাঁর বাবা-মা :ছয় পৃষ্ঠার চিঠিতে ওয়াকিল লিখেছেন- 'ঘটনার দিন রাতে আমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ আমার ঘুম ভাঙে ব্যাচমেটের ডাকে। জাকির হোসেন সায়াল আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার সঙ্গে যেতে বলে। একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে আমাকে চেয়ারে বসানো হয়। সে সময় আমার সামনে ছিল তিনজন, ৬০তম ব্যাচের অভিজিৎ দাশ, ৫৯তম ব্যাচের রিয়াজুল ইসলাম জয় ও ৬০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আকাশ। ঘুমের ঘোরে তাদেরকে আমি বলে উঠি, আসসালামু আলাইকুম স্যার। এতে ওরা হাসতে থাকে। পাশে দেখি আমার রুমমেট সাকিব হোসেন খুব খারাপ অবস্থায় আছে। জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। চুল এলোমেলো। চেহারা বিবর্ণ। তারা আমাকে ১৭/সি কক্ষের খালি কোনা বরাবর চেয়ারে বসায়। তখন ৫৯তম ব্যাচের রিয়াজুল ইসলাম জয়, ৬০তম ব্যাচের অভিজিৎ দাশ, আকাশ, ৬১তম ব্যাচের ইমতিয়াজ আলম, সিরাজ, সাহেদুল ইসলাম হৃদয়, মো. হারিত, ৬২তম ব্যাচের সাজু দাস, জাকির হোসেন সায়েল, সৌরভ দেবনাথ, চমন দাশ, ইব্রাহিম, মো. শোয়েব, মাহিন আহমেদ, ফাহিম জিজ্ঞাসা করে আমিও সাকিবের সঙ্গে কোথাও ক্লাস নিতে যাই কিনা। আমি না উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে, তুই তো যাস; আর কে কে যায় বল। এমন বলেই আমাকে স্টাম্প, লাঠি, পাইপ দিয়ে পেটানো শুরু করে। এক পর্যায়ে বলে আমি সাকিবকে সব কাজে কেন মদত দিই। তারা সাকিব হোসেনকে সামনে নিয়ে আসে। তাকে বলে আমাকে চড় দিতে। সে না বলায় তাকে ওরা মারতে থাকে। ফজরের নামাজের আজান দিলে তারা আমাকে ১৯/এ কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আবার চড়থাপ্পড় মারে। আমার ডান হাত ও পা পুরোপুরি অবশ হয়ে যায়। এমন অবস্থা হয়েছে যে পিঠও বিছানায় রাখতে পারছিলাম না। আমার কক্ষে পাঠানোর আগে তারা আমাকে বলে, 'আজকের ঘটনা জানাজানি হলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে।'

সাকিব ও তাঁর পরিবারের লেখা চিঠিতেও বর্বরতার বর্ণনা :চমেক অধ্যক্ষের কাছে লেখা সাত পৃষ্ঠার চিঠিতে সাকিব হোসেন উল্লেখ করেন- ঘটনার দিন গত বুধবার রাত ১টার দিকে আমার রুমে ৬২ ব্যাচের জাকির হোসেন সায়েল, ইব্রাহিম সাকিব, সাহিন, সাজু দাশ, সৌরভ দেবনাথ এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে যায়। 'বড় ভাইরা' ডাকছে বলে আমাকে ১৭/এ রুমে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি ৫৯ ব্যাচের রিয়াজুল ইসলাম জয়, ৬০ ব্যাচের অভিজিৎ দাশ, আকাশ, ৬১ ব্যাচের সাজেদুল ইসলাম হৃদয়, মো. হাবিব, ইমতিয়াজ আলম, নিব্রাজ, ৬২তম বাচের শোয়েব, চমন দাশ ও ফাহিম উপস্থিত। এ ছাড়া আরও চার-পাঁচজন ছিল তাদের নাম জানি না। আমাকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে আঘাত করে ইমতিয়াজ আলম। তারপর আমার মুখ বেঁধে ফেলে এবং মুখে পানি ঢালতে থাকে। এক পর্যায়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে পানি ঢালা বন্ধ করে। তারপর ওদের তালিকা থেকে কয়েকজনের নাম বের করে বলে আমিসহ ওরা কোথাও ক্লাস নেই কিনা? 'আমি জানি না' বলার সঙ্গে সঙ্গে স্টাম্প, প্লাস্টিকের পাইপ, কাঠের তক্তা দিয়ে মারা শুরু করে। নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে আমার। তখন ওরা হাত-পায়ের জয়েন্টগুলোতে স্টাম্প দিয়ে অনেক জোরে জোরে আঘাত করে। আমার কাছ থেকে কোনো তথ্য না পেয়ে রাত আড়াইটার দিকে ওরা আমার রুম থেকে ওয়াকিলকে ডেকে নিয়ে আসে। তার ওপরও চলে নির্যাতন। এক পর্যায়ে আরও দু'জনকে আলাদা আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে আসে। সকাল ৭টার দিকে মারতে মারতে যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে যায় তখন আমাকে আর মোবাশ্বিরকে কক্ষ '১৭/এ' তে আটকে রাখে। অন্য দু'জনকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় জানি না। পরের দিন দুপুর ১টার দিকে আমাকে আমার রুমে পাঠিয়ে দেয় এবং বলা হয় যদি এ ব্যাপারে মুখ খুলি তারা আমাকে জানে মেরে ফেলবে। এরপর আমাকে আইসিইউতে নিয়ে এলে সাজু দাশ, সৌরভ দেবনাথ, জাকির হোসেন সায়েল, ইব্রাহিম, সাকিব ১১ ফেব্রুয়ারি তিনবার আইসিইউতে ঢুকে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে গেছে। সাজু দাশ এসে বলে, 'এবারে আইসিইউতে আছিস; পরের বার মর্গে থাকবি।'

জনপ্রিয় হওয়ার কারণেই মারধর :শিবির করার অপরাধে তাদের 'শাসানো' হয়েছে বলে অভিযুক্তরা প্রচার করলেও আসল ঘটনা ভিন্ন। মূলত শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের কাছে 'জনপ্রিয়' হওয়ার কারণেই চার শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পিটিয়ে আইসিইউতে পাঠিয়েছে অভিযুক্তরা। দরিদ্র পিতা-মাতা অনেক আশা নিয়ে তাদের চমেকে ডাক্তার বানাতে পাঠিয়েছেন। কোনোভাবেই যাতে তাদের পড়াশোনা বন্ধ না হয় সে ব্যাপারেও আকুতি জানিয়েছিলেন নির্যাতনের শিকার ছাত্ররা। কিন্তু কোনোভাবেই মন গলেনি অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের। ক্যাম্পাসে এরা সবাই শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। চার শিক্ষার্থীকে নির্মম নির্যাতনের ঘটনা আলোচিত হলেও এখনও ক্যাম্পাস ছাড়েনি অভিযুক্তরা। ছাত্রাবাস ও কলেজে নিয়মিত মহড়া দিচ্ছে তারা।

নিন্দা জানিয়ে ছাত্র অধিকারের বিবৃতি :চমেক ছাত্রাবাসে চার শিক্ষার্থীকে শিবির আখ্যা দিয়ে রাতভর ছাত্রলীগের নির্যাতন এবং আইসিইউতে গিয়ে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। চমেকের ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ২১ নেতাকর্মীকে ছাত্রলীগের বহিস্কার করাকে আইওয়াশ আখ্যা দিয়েছে তারা। গতকাল ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাবি শাখার সভাপতি আসিফ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক আহনাফ সাঈদ খান এ বিবৃতি পাঠান।

বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, আবরার স্টাইলে ছাত্র নির্যাতন ও চিকিৎসায় বাধা সৃষ্টি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং ফৌজদারি অপরাধ। একদিকে ছাত্রলীগ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত নেতাদের বহিস্কার দেখিয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে চমেকে তাদের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করছে। এই বহিস্কারকা যে আইওয়াশ ছাড়া কিছু নয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2