১৬ মাসে খুলনায় ৪৮ খুন, নভেম্বরেই ৭
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৫ | আপডেট: ০৪:১৯ পিএম, ১০ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৫
৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত ১৬ মাসে খুলনায় ৪৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সন্ত্রাসীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, মাদক ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে হত্যাকান্ড হয়েছে ২০টি। চলতি নভেম্বর মাসেই ৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক হত্যাকান্ডে ভয় আর আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হচ্ছে খুলনা। দিন-দুপুরে আদালত এলাকার মতো জনবহুল জায়গায় এমন হত্যাকান্ড মানুষকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
পুলিশের তথ্য বলছে, গত ১৬ নভেম্বর দুপুরে নগরীর ৩১নং ওয়ার্ডের কমিশনারের কালভার্ট এলাকায় বাড়ির মধ্যে নানী মহিতুন্নেসা (৫৫), তার নাতি মুস্তাকিম (৮) এবং নাতনি ফাতিহা (৬) কে হত্যা করা হয়। ওই রাতেই করিমনগরে নিজ বাড়ির ভেতর আলাউদ্দিন মৃধা নামের এক যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২৭ নভেম্বর রাতে খালিশপুর ফেয়ার ক্লিনিকের সামনে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় যুবক ইমানকে। সর্বশেষ ৩০ নভেম্বর দুপুরে আদালত চত্বরে আরও দুটি খুনের ঘটনা। একের পর খুনে উদ্বিগ্ন নাগরিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। ধারাবাহিক হত্যা ও সহিংস ঘটনার প্রতিবাদে খুলনা মহানগর বিএনপি’র পক্ষ থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এছাড়া আইনশৃখলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে গত শনিবার নগরীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আইন অধিকার বাস্তবায়ন ফোরাম। তার একদিন পরেই আরও দুটি নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটলো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে চরমপন্থীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল খুলনা। নতুন শতাব্দির শুরুতেও তা বহাল ছিল। বোমা মেরে অথবা গুলি করে মানুষ হত্যা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারান সাংবাদিকসহ অসংখ্য মানুষ। পরবর্তী তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার দক্ষিণাঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে র্যাব গঠন করেন। যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে শুরু হয় অপারেশন ক্লিনহার্ট, অপারেশন স্পাইডার ওয়েব। এসব অপারেশন অধিকাংশ চরমপন্থী সন্ত্রাসী নিহত হন, অনেকে গ্রেফতার হন। ধীরে ধীরে শান্তি ফিরে আসে খুলনায়। খুলনার আইনশৃখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবারও বিশেষ অভিযান শুরুর দাবি জানিয়েছেন নাগরিক নেতারা।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, “বেশিরভাগ হত্যার কারণ উদ্ঘাটন করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। এই হত্যার সঙ্গে জড়িতরাও দ্রুত গ্রেফতার হবেন।”
খুলনায় জোড়া খুনের ঘটনায় পাঁচ বিষয় সামনে রেখে তদন্ত শুরু : খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে দুই শীর্ষ অপরাধী হাসিব হাওলাদার এবং ফজলে রাব্বি রাজন হত্যার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জোড়া খুনের পিছনে চারটি সম্ভাব্য কারণ যাচাই করছেন। তবে পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত কোনও সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়নি।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসীদের গুলী ও ছুরিকাঘাতে ফজলে রাব্বি রাজন ও হাসিব ভুক্তভোগীদের পরিবার কোনও মামলা দায়ের করেনি। পরিবারের কোনও সদস্য মামলা না করলে পুলিশ অভিযোগকারী হিসেবে মামলা দায়ের করবে। এখনও কোনও সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়নি।
এদিকে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, খুলনার নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুই শীর্ষ চরমপন্থী নেতা নাসিমুল গণি ওরফে নাসিম এবং আরমান শেখ ওরফে আরমিন – হাইকোর্টের জামিনে মুক্তি পাওয়ার মাত্র দুই দিন পরেই এই হত্যাকান্ড ঘটেছে। উভয়ই দৌলতপুর-ভিত্তিক অপরাধী “টাইগার খোকন” হত্যার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। ঘটনার পর থেকে তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের মুক্তির ফলে খুলনার অপরাধ জগতে অস্থিরতা তীব্র হয়েছে বলে জানা গেছে। খুলনায় বর্তমানে সাতটি বড় গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী চরমপন্থী এবং অপরাধী গোষ্ঠীগুলি আধিপত্যের লড়াইয়ের অংশ হিসাবে আরও আক্রমণ চালাতে পারে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা আশংকা করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রোববারের ঘটনার সময় আদালতে কর্তব্যরত পুলিশদের কাছে কেবল লাঠি ছিল, আগ্নেয়াস্ত্র নয়, যার ফলে হস্তক্ষেপ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, অপরাধীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়।
পুলিশের মতে, কুখ্যাত গ্যাং লিডার ‘রনি চৌধুরী বাবু ওরফে গ্রেনেড বাবু গ্রুপ’ এই জোড়া খুনের সাথে জড়িত। খুলনা কারাগারে বাবুর সমর্থকদের সাথে পলাশ গ্রুপের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার সময় নিহতরা কারাগারেই ছিলেন এবং সংঘর্ষে অংশ নেন। তার প্রতিশোধ হিসেবে এই হামলার কারণ হতে পারে।
তদন্তকারীরা চারটি উদ্দেশ্য বিবেচনা করছেন, এগুলো হচ্ছে- ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরবর্তী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিবর্তনের পর মাদক নেটওয়ার্কের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, বাবু গ্রুপ এবং পলাশ অনুসারীদের মধ্যে সাম্প্রতিক কারাগারে সংঘর্ষের প্রতিশোধ এবং সোনা, অস্ত্র এবং মাদক চোরাচালানের রুট নিয়ে প্রতিযোগিতা।
কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ত ম রোকনুজ্জামান বলেন, খুলনার অপরাধ জগত একাধিক উপদলের মধ্যে বিকশিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পলাশ গ্রুপ, গ্রেনেড বাবু গ্রুপ, নূর আজিম গ্রুপ এবং হুমা, আরমিন এবং নাসিমের নেতৃত্বে পৃথক উগ্রপন্থী গোষ্ঠী। নাসিম এবং আরমিনের মুক্তির পর তাদের কার্যক্রম পুনরায় সক্রিয় করেছে। তিনি নিশ্চিত করেছেন, পুলিশ আইনজীবী এবং পথচারীদের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ থেকে ছবি সংগ্রহ করেছে। শীঘ্রই খুনিদের গ্রেফতারের সম্ভাবনা রয়েছে।





