avertisements 2

করোনায় ধর্মচর্চা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:১৪ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

রাশেদুল ইসলাম: পূর্ব প্রকাশিত লেখার পর পর্ব ২ ‘করোনায় ধর্মচর্চা’ বিষয়ে গতকালের লেখাটি অনেকে পছন্দ করেছেন । তাই, আবারও লেখার চেষ্টা । এখানে বলতে দ্বিধা নেই যে, কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এ লেখাটা শুরু হয়নি । এখনও এ বিষয়ে কোন গোছালো পরিকল্পনা আমার নেই । লেখাটা তাই এলোমেলো হতে পারে । সম্মানিত পাঠকের কাছে এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী । এখানে আর একটা কথা বলা দরকার যে, ধর্ম আমাদের অনেকের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং আবেগের বিষয় । এ লেখার আলোচনা ও ব্যাখ্যা অনেকটা আমার নিজস্ব ।

আমার আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে, কেউ যেন এ ব্যাখ্যায় কোনভাবে আহত না হন । তারপরও কোন বিষয়ে কারো মনে প্রশ্ন থাকলে, অনুগ্রহ করে জানাবেন – আমি শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করব । এর অর্থ এই যে, কাউকে কোন ভাবে আহত করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয় । ধর্ম বিষয়ে আমার আনুষ্ঠানিক কোন পড়াশুনা নেই । ব্যক্তি জীবনে আমি উত্তম ধর্মচর্চাকারি কোন ব্যক্তি- তাও নই । কিন্তু, আমার লেখায় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে বিস্তর উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয় । বর্তমানে আমার লেখা ৫ টি বই বাজারে আছে । আমার এমন কোন বই নেই, যেখানে ধর্মের বিধানের কথা উল্লেখ নেই ।

এ কারণে অনেকে বলেন, আমার লেখা সার্বজনীন নয় । অনেকে বলেছেন, আমার লেখায় ঘুরেফিরে যদি ধর্মের প্রসঙ্গ না টানা হয়; তাহলে লেখা কালজয়ী হতে পারে । তারপরও আমি ধর্ম নিয়ে লিখি; আমার লেখায় ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে আনি । কিন্তু, কেন ? এ প্রশ্ন আমার কাছে নতুন নয় । জবাবও দিয়েছি কয়েকটি লেখায় । প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানেও এ প্রশ্নের একটা জবাব দিতে চাই আমি। আসলে সাহিত্য সৃষ্টি করা আমার লক্ষ্য নয় । কোন সাহিত্যিক হওয়াও আমার জীবনের উদ্দেশ্য নয় । একটা বিশেষ কারণে আমি ২০১৬ সাল থেকে লেখা শুরু করি । আমার লেখার সেই পটভূমি বেশ কিছুটা নয়; বলা যায় পুরোটাই আবেগের । আমাদের দুটি শিশুপুত্র ১৯৯২ এবং ১৯৯৪ সালে মারা যায় ।

ছেলে দুটির নাম অর্পণ এবং দর্পণ । সেদিন আমার মনে হয়েছে ছেলে দুটিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার । সেই চিন্তা থেকেই পরবর্তীতে ‘অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশন’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান (এখনও পুরোপুরি চলমান নয়) গড়ে তোলা হয় । তখন প্রশ্ন আসে, এই প্রতিষ্ঠানটি কি কাজ করবে ? অকাল প্রয়াত দুটি শিশুর নামে তৈরি এই প্রতিষ্ঠান কি কাজ করতে পারে ? মূল আবেগের ব্যাপার হয় তখনই । ইসলাম ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী শিশু অবস্থায় যারা মারা যায়, তারা ফেরেশতার মত । তারা নিস্পাপ । তাহলে যারা নিস্পাপ শিশু, তারা যদি নিস্পাপ অবস্থাতেই বড় হয়, তখন তারা কি করে ? নিশ্চয়ই নিস্পাপ বড় বড় শিশুরা পৃথিবীর যাবতীয় ভালো কাজ করে ।

আবার প্রশ্ন আসে, পৃথিবীর ভালো কাজ কি কি এবং তা কত প্রকার ? পরের প্রশ্ন, একজন ব্যক্তি, পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কি দুনিয়ার সব ভালো কাজ করা সম্ভব ? যদি তা অসম্ভব হয়, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের করণীয় কি হতে পারে ? ‘ শেষ পর্যন্ত ‘অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশন’ এর কাজ দাঁড়ায় দুটিঃ এক) পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক সৎকর্ম করা এবং দুই) সকল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, যেন তারা সবাই ভালো কাজ করেন ।

সকলে যদি যার যার অবস্থান থেকে ভালো কাজ করেন; তাহলেও প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে । ফাউনডেশন’ এর এই দুই নম্বর কাজের উদ্দেশ্য পূরণ করতেই লেখালেখিতে আমাকে হাত দিতে হয় । তবে, প্রশ্ন আসে একজন মানুষ আমার কথায় ভালো কাজ করবেন কেন ? জীবনটা যদি একটাই হয়, তাহলে একজন মানুষ যতদিন বাঁচেন, আরাম আয়েস করেই বাঁচবেন; তিনি কেন অন্যের ভালো নিয়ে চিন্তা করবেন ? আবার এটাও সত্য, সমাজের অনেকেই কাজ করে থাকেন ।

তাহলে প্রশ্ন, মানুষ ভালো কাজ করেন কেন ? এবং কার কথায় করেন ? এ সব প্রশ্ন থেকেই বিভিন্ন মতাদর্শ, ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের কথা আসে । আমি নিজে সাধারণ মানুষ পছন্দ করি । সাধারণ জীবন পছন্দ করি । একজন সাধারণ মানুষ নিজে নিরলস পরিশ্রম করেন । সুখদুঃখের মাঝে চরম দুর্দিনেও সংসার থেকে পালিয়ে যান না । আমার মনে হয়, সংসারে পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বের মধ্যে টিকে থেকে, একটা নীতি বজায় রেখে, যিনি অন্য মানুষ এবং সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কাজ করতে পারেন, তিনিই আদর্শ মানুষ । এ ধরণের সফলতম একজন মানুষের নাম হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ।

মানুষ ভালো কাজের উদাহরণ দেখতে চায় । একটা গাইডলাইন চায় । সেদিক দিয়ে নবী করিম (সঃ) আদর্শ এবং অনুসরনীয় । এখানে ইসলাম ধর্ম এবং এ ধর্মের বিধান অনিবার্যভাবে চলে আসে । আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান এবং ধর্মভীরু । আমার মনে হয়েছে নবীর জীবন দৃষ্টান্ত এবং ধর্মের বিধান ঠিকমত বোঝাতে পারলে, তাঁদের দ্বারা সমাজে অনেক মঙ্গলকর কাজ করানো সম্ভব । তবে, পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষকে আমি সম্মান করি ।

শুধু ইসলাম ধর্ম নয়, পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষ আমার লক্ষ্য দল । সকল ধর্মেই সমাজ ও মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করার নির্দেশনা রয়েছে । আমি আমার লেখায় সেগুলো তুলে ধরি; যেন ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষ সৎকাজে উদ্বুদ্ধ হয় । এখানে আর একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় । এই পাক-বাংলা-ভারত উপমহাদেশে ধর্ম এমন স্পর্শকাতর বিষয় যে, এখানে সমাজের জন্য কিছু করতে হোলে, অবশ্যই ধর্মের ছায়াতলে করতে হবে ।

উদাহরণ হিসাবে রাজা রামমোহন রায়ের কথা বলা যায় । রাজা রামমোহন রায় নিজে যে খুব ধার্মিক ছিলেন, তা নয় । কিন্তু, তিনি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের উপর ব্যাপক পড়াশুনা করেন । লেখালেখি করেন । নিজের প্রিয় বৌদিকে জোর করে তাঁর মৃত স্বামীর জলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মারতে দেখে, তিনি মর্মাহত হন । সেদিনই এই জঘন্য অমানবিক প্রথা উচ্ছেদ করার সংকল্প নেন তিনি এবং ১৮১২ সাল থেকে সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন ।

সতীদাহ প্রথা ৪ ডিসেম্বর, ১৮২৯ সালে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় । কিন্তু, বাস্তবে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত এদেশের মাটিতেও সদ্য হিন্দু বিধবা মেয়েদের শ্মশানে নিয়ে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত । রাজা রামমোহন রায় বেদ- উপনিষদ ঘেঁটে দেখিয়েছেন, এটা সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থের বিধান নয় । কথিত আছে, দক্ষ রাজার কন্যা শিবের স্ত্রী সতী স্বামীর সাথে জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেন । এই পৌরাণিক কাহিনী থেকেই সতীদাহ প্রথার জন্ম ।

এটা সনাতন হিন্দুধর্মের মৌলিক কোন বিধান নয় । অথচ, একটা হিসাবে দেখা যায়, ১৫০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এই উপমহাদেশের হাজার হাজার হিন্দু বিধবা মেয়েকে সতীদাহ প্রথার নামে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে । রাজা রামমোহন রায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছের লোক ছিলেন । তাঁর সাথে ছিলেন উইলিয়াম কেরীর মত ঋষিতুল্য ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত লোকেরা । সর্বোপরি তখন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেনটিঙ্ক । তিনি সাহসী এবং মানবিক গুণসম্পন্ন ছিলেন ।

হিন্দুদের ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র অভিযোগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ভয় থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর, সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার আইন পাশ করেন । সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে পরবর্তীতে হাজার হাজার হিন্দু বিধবা মেয়ে স্বামীর জলন্ত চিতায় দগ্ধ হয়ে পুড়ে মরার হাত থেকে রক্ষা পায় । আমি এই সুযোগে লর্ড উইলিয়াম বেনটিঙ্কসহ যারা সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন; তাঁদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । সমাজের সংঘটিত অপরাধের একটা বড় অংশ ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণে হয়ে থাকে ।

দেশের নীতিনির্ধারণের সাথে যারা জড়িত, তারাসহ দেশের সাধারণ মানুষের যদি ধর্ম বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকে; তাহলে এমনি এমনিই সমাজের অনেক অপরাধ কমে যায় । এই বিশ্বাস থেকেই আমি আমার লেখায় ধর্মকে টেনে আনি । অনেক লেখা হয়েছে । আজ এ পর্যন্তই । সম্মানিত পাঠক যদি চান- এ লেখা চলমান থাকতে পারে । সম্মানিত ডাক্তারগণসহ মাঠ পর্যায়ে যারা করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট এই মহাদুর্যোগে জীবনবাজি রেখে কাজ করছেন- তাঁদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । পৃথিবীর সকল মানুষ করোনা ভাইরাসের এই মহাদুর্যোগ থেকে মুক্তি পান – এই প্রত্যাশা । ৩০ মার্চ, ২০২০ ।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2