avertisements 2

বিবিসির বিশ্লেষণ

ভারতকে দুশ্চিন্তায় রেখে ট্রাম্প ক্রমশ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছেন কেন

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ আগস্ট,শুক্রবার,২০২৫ | আপডেট: ০১:৩৩ পিএম, ২ আগস্ট,শনিবার,২০২৫

Text

ছবি : সংগৃহীত 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় দুনিয়ার ‘ট্যারিফ কিং’ বা ‘শুল্ক বসানোর রাজা’ ভারতের ওপর বুধবার ২৫ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক, আর তার ওপর তথাকথিত ‘রাশিয়া পেনাল্টি’ হুকুম জারির কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সঙ্গে বিরাট এক জ্বালানি সমঝোতার কথা জানান। পাকিস্তানের ‘বিপুল খনিজ তেলের মজুদ’ সদ্ব্যবহার করতে যুক্তরাষ্ট্র যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, ঘোষণা করেন সে কথাও। নিজের ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট থেকে এটাও লিখতে ভুললেন না—‘কে জানে, একদিন হয়তো দেখা যাবে এই পাকিস্তান ভারতেও তেল বিক্রি করছে!’

অথচ ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম দফার মেয়াদে এই পাকিস্তান সম্বন্ধেই ট্রাম্প মন্তব্য করেছিলেন, ‘এরা আমাদের মিথ্যে আর ধোঁকা ছাড়া কিছুই দেয়নি।’ কিন্তু এই দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সেই অবস্থান থেকে তিনি শুধু ‘ইউ টার্ন’ই করেননি, ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক দিন-কে-দিন ক্রমেই আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
তার পাশাপাশি নয়াদিল্লিকে ‘খোঁচা’ দেওয়ার কোনো সুযোগই যেন ট্রাম্প ছাড়তে চাইছেন না!

এই ধারাবাহিকতাতেই ট্রাম্প বুধবার জানান, পাকিস্তানের বিপুল তেল সম্পদ যৌথভাবে বিকশিত করার জন্য তাদের দুই দেশ সমঝোতায় পৌঁছেছে এবং কোন মার্কিন কম্পানি এই পার্টনারশিপে নেতৃত্ব দেবে, সেটাও এখন বাছাই করার কাজ চলছে।

জ্বালানি খাতের এই সমঝোতা সাম্প্রতিক পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ডায়নামিক্সে সবশেষ সংযোজন, যদিও পাকিস্তানে এই তেলের মজুদ ঠিক কোথায় সেটা ট্রাম্প কিছু ভেঙে বলেননি।

ভূ-রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা অবশ্য এই সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি দেখে বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ইসলামাবাদের যে একটা নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে, তাতে কোনো ভুল নেই।

এই জ্বালানি সমঝোতার ঘোষণাও এমন একটা সময়ে এলো, যখন পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে।
গত সপ্তাহেই পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার তার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে দেখা করার পর জানিয়েছিলেন, দুই পক্ষ চুক্তির ‘খুব কাছাকাছি’ পৌঁছে গেছে এবং দিনকয়েকের মধ্যেই তা চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

কিন্তু পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবেশী ভারতের জন্য এর অর্থ কী? ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে মোড় নিচ্ছে তাতে কি ভারতের বিচলিত হওয়ার কারণ আছে?


মার্কিন জেনারেলকে পাকিস্তানের সামরিক সম্মান
তবে এই তেল সমঝোতা বা সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তির বাইরেও এমন অনেক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা থেকে পরিষ্কার যে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটন পরস্পরের কাছাকাছি আসতে চাইছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (ইউএসসেন্টকম) প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলাকে পাকিস্তান তাদের অন্যতম শীর্ষ সামরিক খেতাব ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজে’ ভূষিত করেছে। বলা হয়েছে, আঞ্চলিক শান্তির প্রসার ও পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্কে তার অবদানের স্বীকৃতিতেই এই সম্মান অর্পণ করা হলো।

তবে এই পদক্ষেপ যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তানের একটা কৌশলগত বার্তা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে জেনারেল কুরিলাকে এই খেতাব তুলে দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি স্বয়ং। সেই অনুষ্ঠানের কয়েক সপ্তাহ আগেই জেনারেল মাইকেল কুরিলা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে পাকিস্তানকে ‘ফেনোমেনাল পার্টনার’ বা অসাধারণ এক সঙ্গী বলে বর্ণনা করেছিলেন। ফলে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও দুই দেশ এখন আবার কাছাকাছি আসছে—এ ইঙ্গিত পরিষ্কার।

ট্রাম্পের সঙ্গে ফিল্ড মার্শালের মধ্যাহ্নভোজ
এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে বদলাচ্ছে, তা অবশ্য খুব ভালোভাবে টের পাওয়া গিয়েছিল মাস দেড়েক আগেই, যখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
বন্ধ দরজার আড়ালে খাবারের টেবিলে বসে দুজনের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল তা অবশ্য জানা যায়নি।

তবে পরে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র অ্যানা কেলি জানিয়েছিলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘সম্ভাব্য পরমাণু যুদ্ধ’ ঠেকানোয় ট্রাম্পের অবদানের স্বীকৃতিতে পাকিস্তান তার নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করার পরই এই বৈঠক চূড়ান্ত করা হয়।

আরো যেটা লক্ষ্যণীয়, সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ওই সফরের ঠিক পর পরই জুলাই মাসের গোড়ায় ওয়াশিংটন ডিসিতে যান পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রধান জাহির আহমেদ বাবর সিধু। ‘দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা’ আরো উন্নীত করতে এবং ‘পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে’ আলোচনা করতে ওই সফরে তিনি পেন্টাগন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ক্যাপিটল হিলে একের পর এক বৈঠক করেন।

অনেক সামরিক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন, এয়ার চিফ মার্শাল সিধুর সফরের প্রধান লক্ষ্যই ছিল মার্কিন ডিফেন্স হার্ডওয়ার বা ভারী সামরিক সরঞ্জাম পাওয়ার পথ প্রশস্ত করা।

প্রসঙ্গত, পাকিস্তান বেশ কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ ব্লকের ৭০টি যুদ্ধবিমান, এআইএম-৭ স্প্যারো এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল ও হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেমের ব্যাটারি কেনার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি, ট্রাম্প পরিবারকে ব্যবসার সুযোগ
অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেও মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ছিল বেশ শীতল। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের পূর্বসূরী জো বাইডেন তো তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করতেও রাজি হননি। কিন্তু জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পরই সেই পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটান।

৪ মার্চ মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তার প্রথম ভাষণেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তানের নাম করে তাদের ‘বিশেষ ধন্যবাদ’ জানান, অ্যাবি গেট বোমা হামলার মূল ষড়যন্ত্রকারীকে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে তারা যেভাবে সাহায্য করেছে তার জন্য।

ভূ-রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের সম্বন্ধে ট্রাম্পের এই মনোভাব বদলানোর পেছনে দুটি ফ্যাক্টর কাজ করে থাকতে পারে। প্রথমত, পাকিস্তান ক্রিপ্টোকারেন্সি সিস্টেমকে গ্রহণ করছে এবং ‘ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফিনান্সিয়াল’ নামে ট্রাম্প পরিবারের মালিকানায় থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে অংশীদারে যেতে রাজি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য পাকিস্তান ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করেছে।

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ কে সি সিংয়ের মতে, ‘পাকিস্তানকে ট্রাম্প যে আচমকা এতটা ভালোবাসতে শুরু করেছেন, তার পেছনে অবশ্যই এই দুটো ঘটনারই বড় ভূমিকা আছে।’

গত মে মাসের প্রথমার্ধে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ ও তারপর পাকিস্তানের পাল্টা জবাবকে কেন্দ্র করে দুই দেশ যেভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, সেই ঘটনাও ট্রাম্প ও ইসলামাবাদের মধ্যে আস্থাকে বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ ওই সংঘাত শুরু হওয়ার চার দিনের মাথাতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সবার আগে দাবি করেন, তার সরকারের মধ্যস্থতাতেই ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সত্যি সত্যি যুদ্ধবিরতি কার্যকরও হয়ে যায়।

পরে পাকিস্তান তার বক্তব্যকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিলেও ভারত এখনো যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন মধ্যস্থতার দাবি স্বীকার করতেই রাজি হয়নি। ভারতের পার্লামেন্টেও সরকার দাবি করেছে, যুদ্ধবিরতিকে তৃতীয় কোনো দেশের কোনো ভূমিকাই ছিল না। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো বারবারই বলে চলেছেন, তিনিই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছেন।

এই আবহে তার কোন পক্ষের দিকে ঝোঁকাটা স্বাভাবিক, সেটা অনুমান করা কঠিন নয় মোটেই।

ভারতের জন্য কতটা দুশ্চিন্তার?
এদিকে ‘কোয়াড’ জোটের শরিক হিসেবে ভারত বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত অংশীদার’। কিন্তু সম্প্রতি যেভাবে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, তা এশিয়া প্যাসিফিকে সম্পর্কের সমীকরণগুলো দ্রুত বদলে দিতে পারে বলে অনেকের ধারণা। পর্যবেক্ষকরা বলে থাকেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতকে নিয়ে কোয়াড’ জোট তৈরিই করা হয়েছিল এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তিকে রুখতে।

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেই লড়াইতে ভারতকে তাদের পাশে পাওয়ার দরকার ছিল, আর সেই প্রক্রিয়ায় চীনের ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ড’ (সব পরিস্থিতির বন্ধু) পাকিস্তান স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্রের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের আমলে এসে সেই বাস্তবতায় পরিবর্তন ঘটছে, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে গত কয়েক মাসে ‘কোয়াডে’র কথাও খুব একটা শোনা যায়নি।

সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে সি সিংয়ের কথায়, “আসলে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটা ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চেয়েছিল বলেই তারা এতদিন ধরে ‘লং রোপ’ দিয়ে এসেছে, অর্থাৎ ভারতকে ইচ্ছেমতো অনেক কিছু করতে দিয়েছে।”

‘কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য ধাতুর মানুষ। তিনি চাইছেন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ডিল করবে, সেখানে মাঝখানে ভারতের কোনো ভূমিকা থাকবে না।’

এই কারণেই আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ভারতের ভূমিকা অনেকটা খাটো হয়ে গেছে এবং পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতার হাত বাড়াতেও ট্রাম্প প্রশাসনের আর কোনো দ্বিধা কাজ করছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা চড়া হারে শুল্ক ও তার সঙ্গে অতিরিক্ত জরিমানা ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য যেমন বিরাট এক চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে, তেমনি পশ্চিম সীমান্তে এই নতুন সমীকরণ কৌশলগত ও সামরিক দৃষ্টিকোণেও ভারতের জন্য বড় বিপদ সংকেত বয়ে আনছে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2