avertisements 2

মৃত্যুর ১১ বছর পরে নিয়েছেন ব্যাংক ঋণ!

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ অক্টোবর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:০৭ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

মৃত্যুর ১১ বছর পরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য ‘আবারও জীবিত হয়েছেন’ জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার পরেশ চন্দ্র! এ কথা শুনে যে কারোরই চমকে ওঠার কথা। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও এমনই এক ঘটনা ঘটেছে সোনালী ব্যাংকের জয়পুরহাট, ক্ষেতলাল শাখায়।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত পরেশ ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের পাঁচুইল গ্রামের বাসিন্দা। পরেশ ও তার জীবিত স্ত্রী মাখন বালার দুই ছেলে দুই মেয়ে সন্তান আছে। বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র, ছোট ছেলে পলাশ চন্দ্র, মেয়ে অতীতা বালা ও গৌরি বালা।

অভিযোগ উঠেছে মৃত্যুর ১১ বছর পর আবার জীবিত হয়ে ব্যাংকে এসে ঋণ নিয়েছেন পরেশ। সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য তার পরিবারে নোটিশও দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জীবিত হওয়ার পরে নিজের বাড়ি, পরিবারের সদস্য বা অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজনদের কাছে না গিয়ে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল শাখায় গিয়েছিলেন তিনি। এমনকি গ্রামবাসীরাও কেউ তাকে দেখেননি। শুধু ব্যাংকটির ওই শাখায় ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করে তিনি দশ হাজার টাকা ঋণ নেন। আর ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছাড়া অন্য কেউই তাকে দেখেননি। ব্যাংকে থাকা ঋণের কাগজপত্রে এমনটাই প্রমাণ দিচ্ছে।

পরেশের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এখন থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যেও তার সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানের মৃত্যু রেজিস্ট্রার খাতায় পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্রের নাম দেখা যায়। সেখানে পরেশের মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ আছে ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন। আর বুকে ব্যথার কারণে তার মৃত্যু হয়েছিল বলেও উল্লেখ করা আছে।

এদিকে ২৮ বছর আগে মারা যাওয়া পরেশ চন্দ্রের দশ হাজার টাকা এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ক্ষেতলাল শাখা। ডাকযোগে সেই নোটিশ দেওয়া হলে পরেশের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র তা গ্রহণ করেন। সেই চিঠির মাধ্যমেই তিনি জানতে পারেন যে তার বাবার নামে ব্যাংকে দশ হাজার টাকার এমসিডি ঋণ আছে।

পরেশের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র প্রথমে নোটিশটি দেখে ভেবেছিলেন তার বারা জীবিত থাকতে হয়তো ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে উল্লেখ করা ঋণ গ্রহণের তারিখ দেখে নরেশের চোখ কপালে ওঠে! ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর তার বাবা ঋণ নিয়েছিলেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

নোটিশে দেওয়া তারিখ দেখে নরেশ সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায় যোগাযোগ করেন। সেখানে ঋণের সব কাগজপত্র বের করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে জানায় যে ঋণ গ্রহণের তারিখ ঠিক আছে এবং নাগরিকত্ব সনদ, ছবি, জমির কাগজপত্র, স্বাক্ষরসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়েই পরেশ ঋণ নিয়েছিলেন। তখন নরেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের জানান যে তার বাবা ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন।

বিষয়টিতে খোঁজ নিলে দেখা যায়, ব্যাংকের রক্ষিত ৩২৮ নম্বর এমসিডি ঋণের নথিপত্রে পরেশ চন্দ্রের নাম আছে। আবার ঋণ পরিশোধের যে নোটিশ পাঠানো হয়েছে তার সঙ্গেও মিল রয়েছে।

অপরদিকে ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা, ইউপি চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যরা ১৯৯৪ সালে পরেশের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গত ২০২১ সালের ৯ মার্চ আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নরেশ চন্দ্রকে তার বাবার মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়। সেটিতেও মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন উল্লেখ করা আছে।

নরেশ চন্দ্র গণমাধ্যমকে বলেন, ১০ হাজার টাকাটা বড় বিষয় না। কিন্তু মৃত্যুর ১১ বছর পর কীভাবে একজন ব্যাংকে গিয়ে ঋণ নিতে পারেন তাতেই আমরা আশ্চর্য হয়েছি। আমার বাবার নামে ১২-১৪ বিঘা জমি আছে। তিনি জীবিত থাকতে কখনও কোনো ঋণ নেননি। আর আমরাও আগে কখনও বাবার নামে থাকা ঋণ পরিশোধের কোনো নোটিশ পাইনি।

আলমপুর ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম জানান, পরেশ চন্দ্র ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন মারা গিয়ে আবার ২০০৫ সালে কিভাবে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেন তা জেনে হতবাক হয়েছি। সেই সময় ব্যাংকের এ শাখায় কৃষি ও এমসিডি ঋণ নিয়ে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল।

আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম জানান, ইউপি কার্যালয়ের মৃত্যু রেজিস্ট্রারে পরেশের মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ আছে। মারা যাওয়ার ১১ বছর পরে ঋণ নেওয়ার ঘটনাটি খুবই আশ্চর্যকর। সেই সময়ে ক্ষেতলাল সোনালী ব্যাংকে কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। এই ঘটনাটিতেও তখনকার ব্যাংক কর্মকর্তাদের হাত থাকতে পারে।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকার কৃষি, এমসিডি ঋণ দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ৮০ ভাগই অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সেই সময়কার কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার ওপরে সেসব ঋণের দায় বর্তানো আছে। তাদের কয়েকজন অবসরে চলে গেছেন। কিন্তু ঋণ অনাদায়ী থাকায় তাদের কারও ১৬ লাখ, কারও ৯ লাখ এমনকি ২৭ লাখ পর্যন্ত বিভিন্ন অংকের টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব জানান, ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্ট থেকে দেখা গেছে যে পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালে কাগজপত্র ও স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু সেই ঋণটি পরিশোধ হয়নি। এখন ঋণটি শ্রেণিকৃত হওয়ায় তার আসল টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ পাঠানো হয়েছিল।

কিন্তু মৃত ব্যক্তি কিভাবে ঋণ নিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তখন তিনি এই শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন না। তাই এ বিষয়ে তিনি জানেন না।

তবে স্থানীয়দের মধ্যে অনেকের অভিযোগ, ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা কৌশলে মৃত ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে ঋণ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। কিন্তু ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়টিতে কোনো পদক্ষেপ নেন না।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2