avertisements 2

সাপ দেখলেই ডাক পড়ে রফিকুলের, ধরেছেন কিং কোবরাও 

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৭ মে, বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ১১:১৬ এএম, ৫ মে,রবিবার,২০২৪

Text

‘সাপ’ দেখলেই মানুষের ভয়ের শেষ থাকে না। কীভাবে সাপের স্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়া যায় সেই চিন্তায় অস্থির থাকে মন। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রফিকুল ইসলাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাপ দেখলেই ডাক পড়ে রফিকুলের। সাপ উদ্ধার করে তিনি আতঙ্কমুক্ত করেন শিক্ষার্থীদের। বিশাল অজগর এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিষধর সাপ কিং কোবরা উদ্ধার করে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর ঝুলিতে!

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই সাপ উদ্ধারের খবরে ছুটে যাওয়ার কাজ শুরু করেন রফিকুল। উদ্ধার করেন একের পর এক বিষধর সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০০’র বেশি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেসহ সব মিলিয়ে হাজারের কাছাকাছি সাপ উদ্ধার করেছেন রফিক৷ যখনই সাপ বিপদগ্রস্ত হওয়ার খবর আসে তখনই উদ্ধারে ছুটে যান তিনি।

সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন সাপের অভয়ারণ্য। প্রায়ই বিশাল বিশাল অজগর কিংবা রাজ গোখরার মতো বিষধর সাপসহ বিভিন্ন বিষধর সাপের দেখা মেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কখনো কখনো শিক্ষার্থীদের হলেও ঢুকে যায় এসব বিষধর সাপ। আর তখন সাপ উদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভরসা রফিক। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রফিকের সাপ উদ্ধারের নানা কর্মকাণ্ড। তাঁকে ‘সর্পবন্ধু’, ‘স্নেকম্যান’ নামেও ডাকে বন্ধু্রা।

কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষানবিশ সর্প গবেষক রফিকের সঙ্গে৷ আলাপচারিতায় উঠে আসে সাপ নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা ও অজানা কথা৷

রফিকের জন্ম চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে হলেও বাবার চাকরিসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে তাঁর বেড়ে ওঠা৷ পড়ালেখার দীর্ঘসময় অর্থাৎ স্কুল-কলেজ জীবন কাটে আশুগঞ্জে৷


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে তিনি অনার্স শেষ করে একই বিভাগে থেকে মাস্টার্সে ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড কনজারভেশন বায়োলজি ব্রাঞ্চে পড়ছেন। এছাড়া বাংলাদেশ ভেনম রিসার্চ সেন্টারে শিক্ষানবিশ গবেষক হিসেবে কর্মরত থেকে সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি৷

সাপের ভয়কে জয় করে পথচলার প্রসঙ্গে রফিক বলেন, আমিও মানুষ, প্রাণ হারানোর ভয় আমারও আছে। তবে এতোটাও নয়। স্রষ্টা আমাকে এই মহৎ কাজের জন্য মননোনীত করেছেন বলে মনে করি আমি। মানুষের প্রাণ বাঁচানো ও সাপ রক্ষায় প্রকৃতির কল্যাণে কাজ করে যাওয়ায় মানসিক শান্তি আসে আমার মনে। সত্যি বলতে চিন্তা করে দেখলাম ভয়কে জয় করতে না পারলে তো কখনোই মানুষ ও সাপের প্রাণ বাঁচাতে পারবো না। কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে, সবাই যদি ভয় পায় তাহলে মানুষ কীভাবে নিরাপদ হবে।

সাপ নিয়ে কম-বেশি সবার মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করে। ভীতি থেকেই প্রতিনিয়ত নির্বিচারে সাপ মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। সাপের প্রাণ বাঁচাতে আগ্রহী মানুষ নেই বললেই চলে। অথচ প্রকৃতি রক্ষায় জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে সাপকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। সর্পদংশনে মানুষের মৃত্যুর হার কমাতে তাই একটি রেসকিউ টিম গঠন করেন রফিক।

রফিক বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে সাপ বিষয়ক জরুরি সেবা দিতে আমরা ‘Snake awareness’ নামে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছি। যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে সাপ বিষয়ক জরুরি সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সাথে সংযুক্ত আছে দেশ-বিদেশের বহু সর্পবিদ ও সর্পপ্রেমী।

তিনি বলেন, দেশে প্রতিবছর সর্পদংশনে ৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। মূলত বেশিরভাগ সর্পদংশনের দুর্ঘটনা হয়ে থাকে যখন আমরা অসতর্কতাবশত না দেখে সাপের সংস্পর্শে চলে যাই, যদি সাপ পদদলিত হয় কিংবা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাছাড়া যদি কেউ সাপ মারতে যায় কিংবা ইচ্ছাকৃত সাপের সংস্পর্শে চলে যায়। এছাড়া সাপ দ্বারা আমাদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

স্নেক আ্যওয়ারনেস নামে রেসকিউ টিমের উল্লেখযোগ্য কাজ মূলত মানুষের বাসাবাড়িতে বিপদগ্রস্ত সাপ উদ্বার করা। বসতবাড়িতে সাপের উপস্থিতে মানুষ বিপদগ্রস্ত হলে তাদের সহযোগিতা করাসহ সাপ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করাই এই টিমের মূল লক্ষ্য। এছাড়া সাপ বিষয়ক গুজব, কুসংস্কার, প্রচলিত মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য দূরীকরণে কাজ করে এই রেসকিউ টিম৷

রফিক বলেন, বর্তমানে আমাদের ইমার্জেন্সি টিমের ১০ জন রেসকিউয়ার ছাড়াও ৩০ জনের মতো সক্রিয় উদ্বারকর্মী রয়েছে। এছাড়া আমাদের টিমে প্রায় ৫০০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে দেশজুড়ে। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়া অনলাইন ফেসবুক গ্রুপ Snake Awareness-এ বর্তমানে ২৫ হাজার এর মতো গ্রুপ সদস্য রয়েছে, যেখানে অনেকেই অনলাইনে সচেতনতা বিষয়ক কার্যক্রমে ভূমিকা রাখেন এবং সেবা পেয়ে থাকেন।

আলাপচারিতার একপর্যায়ে সাপ উদ্ধারে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা জানান রফিক। তিনি বলেন, একবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ সংলগ্ন রিসার্চ সেন্টারে বার্মিজ অজগর (Burmese Python) উদ্বারে বেশ বেগ পেতে হয় আমি ও আমার টিমকে। রুমটি তালাবদ্ধ ছিল। সাপটি ছিল জানালার ভেতর। সাপের বিশাল আকৃতির দেহটি ভেতরে থাকায় আমরা যথাযথভাবে সাপের মাথাটি কাবু করতে পারিনি এবং সাপটি ও প্রাণনাশের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে তেড়ে আসছিল। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টার পরে সাপটি উদ্বার করতে সক্ষম হই।

আরেকবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন মেডিকেল সেন্টার সংলগ্ন কলোনিতে একটি সাপের ইনফরমেশন আসে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখতে পাই বিষধর রাজগোখরা (King Cobra)। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিষধর সাপ। পরবর্তীতে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে সতর্কতার সঙ্গে ১০ ফুট দৈর্ঘের ওই রাজগোখরা সাপটি উদ্বার করতে সক্ষম হই আমরা এবং ভেনম রিসার্চ টিম।

আলাপচারিতায় রফিক জানান, মূলত দেশের মানুষকে বাঁচাতে এবং সাপের প্রাণ বাঁচিয়ে প্রকৃতি রক্ষার্থেই তার এসব কর্মকাণ্ড।

তিনি বলেন, সাপ সম্পর্কে মানুষ সঠিকটা জানুক। কীভাবে সাপের দংশন থেকে বাঁচা যায় এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো কী? মানুষ সাপ সম্পর্কে ভুল কুসংস্কারগুলো থেকে মুক্ত হয়ে যেন আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তামুক্ত হয়, ওঝার কাছে গিয়ে ভুল চিকিৎসায় মূল্যবান প্রাণ যেন না হারায়, সাপে কাটলে যেন যথাসময়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে। এসব নিয়েই আমি এবং আমাদের টিম প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।

রফিক বলেন, গর্ব করে বলতে পারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর সাপ থাকার পরও শিক্ষার্থীরা সাপ হত্যা করে না। বরং এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সচেতন। শিক্ষার্থীরা এই বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখে এবং আগ্রহের সঙ্গে আমাকে ইনফর্ম করে সাপের প্রাণ বাঁচাতে। ভালো লাগে যখন শিক্ষার্থীদের সর্পবিষয়ক সমস্যায় যেকোনো মুহূর্তে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কাছের একজন হতে পারি।

বর্তমানে বাংলাদেশের গোখরা (Naja sp.) সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করছেন রফিক। পড়ালেখার পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রন (Non Communicable Diseases Control) প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ ভেনম রিসার্চ সেন্টারে বর্তমানে শিক্ষানবিশ গবেষক হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

সাপ আতঙ্ক ও সাপে কাটা বিষয়ে জনসাধারণের উদ্দেশে রফিক বলেন, সর্পদংশনের পর জীবনের প্রতিটি সময় অত্যন্ত মূল্যবান। তাই সময় নষ্ট না করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যাওয়া উচিত। সাপে কাটলে কোনোপ্রকার কাটা ছেড়া এবং বাঁধ না দিয়ে দংশিত বাহুর নিশ্চল অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে৷ আতঙ্কিত না হয়ে যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছে চিকিৎসা নিলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে সর্পচিকিৎসা হয়। সাপে কাটলে ওঝা নয় হাসপাতালে চিকিৎসা হয়।

প্রাচীন নিয়মে কবিরাজ দ্বারা সাপের চিকিৎসা আর বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, সর্পদশংনে বিষক্রিয়া হলে সময়মতো চিকিৎসা না নিলে যেখানে মানুষের প্রাণ চলে যায় সেখানে অবৈজ্ঞানিক ওঝা কবিরাজ কীভাবে মানুষের প্রাণ বাঁচাবে? ওঝারাই বিষক্রিয়া হলে হাসপাতালে ছুটে আসে নিজের প্রাণ বাঁচাতে। যখন অবিষধর সাপের দংশন হয় এবং বিষধর সাপের দংশনে বিষ প্রয়োগ হয় না অর্থাৎ শুষ্ক দংশন হয়ে থাকে তখনই ওঝা কবিরাজ তাদের কারসাজিতে মানুষের মনে রোগী সুস্থ করার বিশ্বাস তৈরি করেন। কিন্তু এর পেছনে মূল সত্যটি অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2