avertisements 2

জোহরান মামাদানির জয়ে মোদি-ভক্তরা কেন ক্ষিপ্ত

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ জুলাই,রবিবার,২০২৫ | আপডেট: ০৬:০৯ এএম, ৬ জুলাই,রবিবার,২০২৫

Text

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের প্রাথমিক পর্বে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন জিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন জোহরান মামদানি। আগামী নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি হবেন নিউইয়র্ক শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয়, প্রথম মুসলিম ও প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়র।

কিন্তু এই ঐতিহাসিক সম্ভাবনা একদিকে যেমন প্রগতিশীল মহলে আশার আলো জ্বালিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে উসকে দিয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া—বিশেষ করে ভারতের হিন্দুত্ববাদী মহল এবং প্রবাসী ভারতীয়দের একটি অংশের মধ্যে।

ধর্মীয় পরিচয় ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া

৩৩ বছর বয়সি মুসলিম এই রাজনীতিকের বিরুদ্ধে নির্বাচন জয়ের পর থেকেই একের পর এক বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন মোদিপন্থী গোষ্ঠীগুলো। কেউ তাকে বলছেন ‘জিহাদি’, কেউবা ‘ভারতবিরোধী’। এমনকি অভিযোগ উঠেছে, তিনি হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করার ‘ষড়যন্ত্রে’ যুক্ত।

ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেট’-এর গবেষণা পরিচালক কায়লা ব্যাসেট বলেন, ‘জোহরানকে আক্রমণের মাধ্যমে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কেই টার্গেট করা হচ্ছে। একে মুসলমানদের প্রতি সন্দেহের বর্ণনা আরও পোক্ত করার কৌশল বলা যায়।’

বিজেপি শিবিরের প্রতিক্রিয়া

জোহরান বরাবরই স্পষ্টবাদী। ভারত হোক কিংবা গাজা—যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেই তিনি সোচ্চার। ফলে তার এই অবস্থান একপ্রকার অস্বস্তি তৈরি করেছে ভারতের শাসক দল বিজেপির ভেতরেও।

বিজেপি সাংসদ ও বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌত সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘জোহরান তো ভারতীয়র চেয়ে পাকিস্তানির মতো শোনায়।’ এরপরই জোহরানের মা ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নায়ারের হিন্দু পরিচয় টেনে এনে তিনি বলেন, ‘তার (জোহরান) হিন্দু পরিচয় বা বংশ যা–ই হোক; এখন দেখছি, তিনি হিন্দুধর্ম ধ্বংস করতেই উদ্গ্রীব।’

ভারতীয় মিডিয়া ও প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া

জোহরানের প্রাথমিক জয়কে কেন্দ্র করে ভারতীয় গণমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে নেতিবাচক প্রচার। ‘আজ তক’-এর এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, তিনি এমন সংগঠন থেকে অর্থ নিয়েছেন যারা ভারতবিরোধী। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে মুসলিম নারীদের পর্দা পরা অবস্থায় ভিডিও দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী ভারতীয়দের একটি অংশও এই প্রচারে সক্রিয়। নিউ জার্সির ‘ইন্ডিয়ান আমেরিকানস ফর কুমো’ নিউইয়র্কের আকাশে একটি উড়োজাহাজ উড়িয়ে ব্যানারে লিখে, ‘গ্লোবাল ইন্তিফাদা থেকে নিউইয়র্ককে রক্ষা করুন। মামদানিকে প্রত্যাখ্যান করুন।’

মানবাধিকার ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান

জোহরান ২০২০ সালে টাইমস স্কয়ারে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে অংশ নেন এবং বিজেপিকে দায়ী করেন। ২০২৩ সালে মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে তিনি জেলে থাকা ভারতীয় অধিকারকর্মী উমর খালিদের লেখা পাঠ করে শোনান।

সম্প্রতি এক টাউন হলে তাকে প্রশ্ন করা হয়, মোদি এলে তিনি দেখা করবেন কিনা। জবাবে স্পষ্ট বলেন, ‘না, তিনি যুদ্ধাপরাধী।’ তিনি অভিযোগ করেন, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময় মোদি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সহিংসতা থামাতে কোনো পদক্ষেপ নেননি।

ধর্ম ও শ্রেণির বিভাজন

সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রোহিত চোপড়া মনে করেন, মোদির বিরুদ্ধে জোহরানের স্পষ্ট অবস্থানই তাকে হিন্দুত্ববাদীদের টার্গেটে পরিণত করেছে। চোপড়া বলেন, ‘হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা ২০০২ সালের ঘটনাগুলো চেপে যেতে চায়। সেই ইতিহাস তুলে ধরায় জোহরান তাদের কাছে বিপজ্জনক।’

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা উচ্চ আয়ের হিন্দুদের একটি অংশ সাধারণ হিন্দু শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পান না। এই শ্রেণিবিভাজনও জোহরানের প্রতি সন্দেহের জন্ম দেয়।

প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠছেন জোহরান

‘পোলিস প্রজেক্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, ‘জোহরানের বিরুদ্ধে অধিকাংশ আক্রমণ তার মুসলিম পরিচয় ঘিরেই। তিনি গর্বের সঙ্গে এই পরিচয় বহন করেন, সেটাই কিছু মহলে অস্বস্তির কারণ।’

জোহরান শুধু মুসলিম নন, তিনি আফ্রিকান এবং গুজরাটি বংশোদ্ভূতও। তার বাবা বিখ্যাত চিন্তাবিদ মাহমুদ মামদানি গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন।

নির্বাচনী শক্তি ও জনভিত্তি

পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, নিউইয়র্ক শহরে ৭ লাখ ১০ হাজার ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ বাস করেন—যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

১ জুলাই ঘোষিত নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, এশীয়-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক ভোটে এগিয়ে আছেন জোহরান। তিনি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়েছেন ৫৬–৪৪ শতাংশ ব্যবধানে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, জোহরানের উত্থান এবং জনপ্রিয়তা শুধু একটি নির্বাচন নয় বরং বৃহত্তর এক সামাজিক-রাজনৈতিক টানাপড়েনের প্রতীক হয়ে উঠেছে—যেখানে ধর্ম, বর্ণ, পরিচয় এবং ক্ষমতার প্রশ্ন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।

ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষের পাল্টা বার্তা

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অরবিন্দ রাজাগোপাল বলেন, ‘জোহরান আজ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সম্ভাব্য মুসলিমবিদ্বেষের এক প্রতিরোধী প্রতীক হয়ে উঠেছেন।’

তিনি বলেন, ‘জোহরান শুধু ইংরেজি নয়—স্প্যানিশ, হিন্দি, উর্দু এমনকি কিছুটা বাংলা বলতে পারেন। এ রকম প্রার্থী এখন খুবই বিরল। নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে লুকিয়ে না রেখে যেভাবে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলেন, সেটাই তাকে এগিয়ে রেখেছে।’

রাজাগোপাল আরও বলেন, ‘নিজের মুসলিম পরিচয়কে যে সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন মামদানি, সেটাই তাকে আজ এগিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মুসলিমবিদ্বেষের আশঙ্কা যেভাবে বাড়ছে, মামদানি ঠিক তার জবাব হতে পারেন।’

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে বলেছিলেন, ‘মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করা উচিত।’ তার যুক্তি ছিল, মুসলিমরা ‘ঘৃণা ও হুমকির উৎস’।

অধ্যাপক রাজাগোপাল বলেন, ‘ট্রাম্পের এই সময়ে তারই প্রতিরোধ হয়ে উঠেছেন মামদানি। তার জয় হিন্দুত্ববাদীদের জন্য একটা বড় বার্তা।’

সূত্র: আল জাজিরা
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2