avertisements 2

বাঙালীর অস্মিতা

জালাল উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ১১:০৬ পিএম, ২২ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:১৮ এএম, ৭ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২৪

Text

আজকাল ভারত শাসিত বাঙালী অধ্যুষিত পঃ বংগ রাজ্যটি বেশ এলোমেলোই বলা চলে। ডমিনিয়ন ভারত বর্ষের তিরিশটি রাজ্যের একটি রাজ্য হিসাবে বাঙালী অধ্যুষিত এই বাংলা রাজ্যটি বরাবরই একটি স্বতন্ত্র স্বকীয়তায় উজ্জ্বল থেকেছে। খন্ডিত বাংলার ওই ভারত শাসিত ভূখন্ডটি বরাবরই শিল্প সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ কেন্দ্র হিসাবে ভারতীয় আঙ্গিনায় একটি সম্মানিত জায়গায় অবস্থান করে নিয়েছে। তবে কোলকাতা কেন্দ্রিক ওই বাঙালীদের শিল্প সংস্কৃতির চর্চিত ব্যকরনে সর্বভারতীয় হওয়ার এক প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী খায়েশ রয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে তারা এগিয়েই ছিল। কিন্তু বেলা গড়িয়ে যাওয়ার পড়ন্তকালে অর্থাৎ স্বাধীন ভারতের অস্তিত্বের অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে আসার পর ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতির আদি আর্য রক্তের পরম্পরার উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিনের ভারত যখন তার মেরামতে এগিয়ে এল তখন আস্তেধীরে ভারতীয় অঙ্গনে বাঙালী উপস্থিতির উঠান সংকুচিত হতে শুরু করলো। এমতাবস্থায় বাঙালী যখন তার নিজ উঠানের দিকে তাকালো তখন তারা যা দেখলো তা তাদের কাছে সুখকর বলে মনে হোল না। তাই তারা এখন আপন আঙ্গিনায় পরস্পর পরস্পরের অচেনা বাঙালী হয়ে মাঠ সরগরমে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনটি ঘটেছিল পুর্ব বাংলায় ধর্মতত্ত্বের রাজনীতি ও রাষ্ট্র গঠনের পরবর্তী সময় কালে। অবশ্য পুর্ব বাংলার অদম্য বাঙালী ধর্ম তত্ত্বের জাতিগঠনের  বেড়াজাল ভেঙ্গে তার স্বমহিমায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের উঠানে থিতু হয়েছে। জাতি হিসাবে বাঙালী তার স্বাধীন স্বত্ত্বায় বাংলাদেশী হয়ে বিশ্ব দরবারে নিজেকে মেলে ধরেছে। বাঙালী অস্মিতার প্রকৃত আধারে আজ তারা নিজস্ব স্বকীয়তায় ভাস্মর।
যারা চিরকাল ভারতীয় আঙ্গিনায় পঁচাত্তর বছরে ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তাদের জীবন যৌবন সমর্পন করেছেন তারাই এখন বাঙালীর অস্মিতা নিয়ে মাঠ গরমের অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে সময় তো অনেক গড়িয়েছে। কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালী বাবুরা যদু মধু কালাম কদমদের অজ পাড়া গাঁয়ের উঠানে কোনদিন পা ফেলেছেন বলে মনে হয় না। তবে ওই অজ পাড়ার অপু শ্রীকান্তদের নিয়ে তারা বিখ্যাত হয়েছেন - এটা বলতে দ্বিধা নেই। বাঙালীর শাশ্বত ঐতিহ্যের বাঙালীয়ানার গল্প উপন্যাস নাটক সিনেমা করে তারা বিখ্যাত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাঙালীর বুনিয়াদ বিনির্মানে তৃণমূলে কাজ করার সদিচ্ছা তাদের কোনদিনই ছিল বলে মনে হয়নি। দিল্লি বা বোম্বাই মুখী থেকে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালী বাবুরা হিন্দুস্থানের হিন্দু সেজে থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করেছেন। নিজ মাটির খন্ডিত অবয়বের বাঙালী উঠান যখন বিদ্ধস্ত ও ধর্মীয় উস্কানির রঙিন মায়াজালে উড়নচন্ডী হয়ে বিচরন করছে তখন অগ্রনী শ্রেনীর ওইসব বাঙালী মাথা ওয়ালা বাবুরা বৃহত্তর ভারতীয় আঙ্গিকে নিজেদেরকে সাজাতে ব্যস্ত থেকেছেন। ইট পাথরের কোলকাতা কেন্দ্রিকতায় তারা শুধু কিতাবী চর্চায় বাঙালীর উঠান সাজাতে মত্ত থেকেছেন। কাদা মাটির গ্রাম বাংলায় তারা অচেনা পরিযায়ী বাঙালী বাবু হয়েই থেকেছেন। মাটি ও মানুষের বাঙালীয়ানার গন্ধ থেকে তারা যোজন যোজন দূরে থেকে হিন্দির হিন্দুয়ানী ও ইংরাজী সান্নিধ্যের মোহজালে আপন অস্তিত্ব বিনির্মানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একসময় এই বাঙালী বাবুদের অতি উৎসাহী চর্বিত চর্বনে হিন্দি সংস্কৃতির উন্নয়নে সফলতাও এসেছে এবং সর্ব ভারতীয় হওয়ার উচ্চাকাংখায় ওটাই কোলকাতার বাঙালী বাবুদের পরম তৃপ্তির খোরাক যুগিয়েছে। আজকের দিনে হিন্দুস্থানী হওয়ার তোড়ে বাঙালীর শিক্ষা ও সভ্যতা এমনকি রাজনীতির উচ্চাভিলাষ যখন হুমকির সম্মুখীন তখন বাঙালীর বাঙালীয়ানার শাশ্বত চাহিদার কোথাও যেন শংকা ও উৎকন্ঠার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।


ফিরে আসি সাতচল্লিশ পুর্ববর্তী বাংলার চালচিত্রে বা তারও পুর্বে। মোঘল শাসনের সর্ব ধর্মের ভারতে হিন্দু প্রাধান্যের রাজা মহারাজা বা জমিদারি তালুক এতদাঞ্চলে চালু ছিল। আস্তে ধীরে ইসলামী সাম্যের বাণী ভারত বর্ষে তথা বাংলার মাটিতে তার অবস্থান শক্ত করে। বার'শ শতকের পর হতে বা তারও আগে আরব দেশীয় পীর ফকির ও মুসলমান ধর্ম পরিব্রাজকদের আগমনে ভারতে ইসলাম ধর্মের সূচনা হয়। ফলে পরবর্তী সময়গুলোতে ইসলামের একাত্ববাদ, সাম্য ও সহমর্মিতার আদর্শের মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে বহু গোত্রীয় সম্প্রদায় ভুক্ত হিন্দুরা নিজেদেরকে ইসলামের ছায়া তলে সমর্পন করে। এক সময় জাত পাত গোত্র ও বহু ধর্মীয় হিন্দুস্থানের মাটিতে মুসলিম ধর্মের একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয়। হিন্দু কোন একক ইউনিটের ধর্ম নয়। হিন্দুস্থানের জাতীয়তাবোধের নাম হোল হিন্দু। সেই প্রেক্ষিতে ধর্মতত্বের হিসাবে ভারত বর্ষের মুসলমানেরাই গরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে সামনে চলে আসে। হিন্দু জাতি আপন স্বত্ত্বা টিকিয়ে রাখার মানসে তাদের পূর্ব পুরুষের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের মন্ত্র গাঁথায় একাট্টা হওয়ার প্রয়াসে এগিয়ে আসে। ফলে তাদের ধর্ম ও আচার সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকলেও দেব দেবীর মুর্তি পুজারীর দল হিসাবে হিন্দু ধর্মের পত্তনে দৃঢ়তা লাভ করে। তাছাড়া আর্য রক্তের ব্রাহ্মন্য সমাজপতিদের পুরনো ঐতিহ্যের পরম্পরায় হিন্দুস্থানের “হিন্দু” জাতীয়তাবোধের ধর্মাচারনে তাদের ধর্মীয় বোধের একাত্মতা সৃষ্টি হয়। ফলে ঐতিহ্যগত অবস্থানের জাতিগত হিন্দু কালচক্রে আজ হিন্দু ধর্মের প্রকাশিত রূপ হয়ে ভারত বর্ষের জাতীয় ধর্মের আসন লাভ করেছে।


ধর্ম তত্ত্বের সুত্র ধরে বাঙালী জাতি যখন দু'টুকরো হলো তখন স্বাভাবিক নিয়মেই  বৃহত্তর বাংলার হিন্দুরা হিন্দুস্থানের “হিন্দু” জাতীয়তাবাদে সামিল হলো। ক্ষেত্র বিশেষে নিয়তির লিখনে সামিল হতে বাধ্য হলো। ধর্মীয় আবেগ উস্কানীতে সাময়িক বিচ্ছেদ বা বিমর্ষতার ঘনঘটা থাকলেও বাঙালি তার সার্বিক বাঙালীয়ানায় একাত্ম ছিল এবং এখনো আছে বলেই মনে হয়। তবে ওই যে বলেছি কোলকাতা কেন্দ্রিক শুদ্ধাচারের বাঙালী বাবুরা বাঙালীর স্বত্ত্বাকে কোলকাতাময় করতে গিয়ে নাড়ির কাঁচা মাটিতে কিছুটা হলেও তো টান ধরেছে। নইলে কোলকাতা আবর্তের জি বাংলা, স্টার জলসা ইত্যাদির সিরিয়াল গুলোর ড্রয়িং রুমে মদ গেলানো বা আট দশ হাজারীর বেনারসী পরা পিসি মাসি বৌদি ও দিদি বোনদের পরকীয় ও সংসার ভাঙ্গার রাজসিক আয়োজন দেখে কি মনে হয় বাঙালী বাবুরা কাদা মাটির আসল বাঙালীদের চিনেন? বা তাদের শেকড়ের কোন খবর তাদের কাছে আছে। শহর কেন্দ্রিক উঁচু সম্প্রদায়ের চলন বলনের বিকৃত কুরুচিপুর্ন উপাদান সংযোজন করে তারা বাঙালীর কোন্ অস্মিতার আয়োজনে ব্যস্ত! বরং এসব সিরিয়াল বা নাটকে তাদের পুর্ব পুরুষ রাজা মহারাজা বা ব্রাহ্মন্য সমাজের কুট কুচক্রের বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দিয়ে তারা এগোতে চাচ্ছেন। বাংলার অজ পাড়া গাঁয়ে কোথায় কোন্ সমাজে এমন সব কুরুচি আবহের ঘটনাপুঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে বা আদৌ তা বাঙালী সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে কিনা তার সদুত্তর কি তাদের কাছে আছে?


আসি তাদের প্রিন্ট মিডিয়ার দিকে। সেখানেও বাংলা ভাষা ও বাক্য বিন্যাসের প্রয়োগে আমরা কি দেখি!  আজকের দিনে বাঙালীর প্রিন্ট মিডিয়া কি আটপৌড়ে বাঙালীর বোধগম্যতায় আছে! উচ্চমার্গের কাট ছাঁটের ওই ছাপানো বাংলা সংবাদ পত্র, স্কুল না পেরোনো কোন বাঙালীর বোধগম্যে আছে কি? কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে স্টাইল ও দ্রুততায় সংবাদ পাঠের আয়োজন করা হয় তা কি আজ গ্রামের সাধারন বাঙালীর ঘরে পৌঁছায়! আবার বনেদীয়ানার নামে এক শ্রেনীর ধুতি পাঞ্জাবীর বাঙালী আঁতেল শ্রেনী যেভাবে জাতে উঠানোর বাংলা উচ্চারনে কতা বাত্তা (কথা)বলেন তা কি বাংলার অস্মিতাকে ধারন করে! বাঙালীর অস্মিতার (জাত্যাভিমান) কথা উচ্চারন করতে গিয়ে কোলকাতার বুদ্ধিবৃত্তির আঁতেলরা প্রায়শঃ ক্ষেত্রে রবীন্দ্র উচ্চারনে ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তারা “গোরা”, “ঘরে বাইরে” ইত্যাদির অনুসরনে বাঙালীর ঐতিহ্যগত অস্মিতায় বুক ফোলান। কিন্তু তারা ঘুনাক্ষরেও রবীন্দ্র সৃষ্ট “শিবাজী উৎসবের” কথা নিয়ে ঘাঁটতে চান না। নাটক সিনেমায় সাম্প্রদায়িক উস্কানী মূলক ও বিধর্মী উষ্মতায় যতসব সৃষ্টি তাদের ঝুলিতে আছে তার নিকাশি তারা কি কখনো করেছেন? আমরা এমনও শুনেছি, এক সময় কোলকাতার বাঙালী বাবুদের দৌরাত্মে মুসলমান নামধারী পরিচালকদের সিনেমার ছাড়পত্র পাওয়া যেত না। ফলে পরবর্তীতে ওইসব পরিচালকদের হিন্দু নাম ধারন করে সিনেমার ছাড়পত্র নিতে হয়েছে। এই যদি বাঙালী অস্মিতার নমুনা হয় তবে হিন্দুস্থানী অস্মিতায় বুঁদ থাকাটাই তাদের জন্য শ্রেয় নয় কি? আর বাঙালী অস্মিতার কথা যখন বলছেনই তখন পারতপক্ষে মৌলবাদী বাঙালী নেতাদের ছেড়ে বরং বাঙালীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুভাস, শরৎ বা সোহরাওয়ার্দী কিংবা হালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শ নিয়ে বাঙালীর আঁতুড় ঘর মেরামতে নেমে পড়ুন।


সুতরাং ঘরে ফিরে আসুন। নিজ উঠানকে মজবুত করার মানসে গ্রাম বাংলার শাশ্বত বাঙালীয়ানাকে সমুন্নত করার কাজে লেগে পড়ুন। ওরা কাঁচা কাদা মাটির মানুষ। ওদেরকে নিয়ে অনেকেই অনেকভাবে খ্যাতি পেয়েছেন। ওদেরকে বুকে টেনে নেয়ার সময় এসেছে। ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশের বিষবৃক্ষ পুনঃরোপনের আগেই ওদের দরজায় কড়া নাড়ুন। নইলে বর্তমান সময়ে ধর্ম তত্বের হুজুগে মন্ত্র পড়ে ওদেরকে যেভাবে ভগত সিংদের শিষ্য বানানোর মচ্ছ্বব শুরু হয়েছে তাতে করে আপনাদের ড্রয়িং রূমে বসে বাঙালীর অস্মিতা নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।  
 
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2